খুলনা, বাংলাদেশ | ১২ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ | ২৬শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  গাজীপুরের কেপিজে হাসপাতালে থেকে ঢাকার এভারকেয়ারে আনা হয়েছে তামিম ইকবালকে
  দেশবাসীকে ঈদের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা

পঁচিশ মার্চের খুলনা

কাজী মোতাহার রহমান

বিশ্বের গণতন্ত্রমনা মানুষ তাকিয়ে ছিল পূর্ব পাকিস্তান নামক ভূ-খন্ডের দিকে। আলোচনার মাধ্যমে উত্তপ্ত অবস্থার অবসান হবে এদেশের ১৯ জেলায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশে স্বোচ্চার কন্ঠের শ্লোগান “ছয় দফা না এক দফা, স্বাধীনতা-স্বাধীনতা”। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কন্ঠে শ্লোগান। ন্যাপ, ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টি অসহযোগ আন্দোলনের সময় জয় বাংলা শ্লোগানের সাথে একমত পোষণ করতে পারেনি। ছাত্রলীগের বিপ্লবী ধারার অংশটি এই শ্লোগানকে এগিয়ে নিতে চায়, গণমানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে চায়। স্বাধীনতা পরবর্তী ছাত্রলীগের এ অংশটি জয় বাংলা শ্লোগান দেয়া থেকে বিরত থাকে।

সবাই আশায় বুক বেঁধে ছিল সত্তুরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে। একাত্তরের ১৫-২৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট জেঃ আগা ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আলোচনা ফলপ্রসু হয়নি। আশা ভরসা ধুলিসাৎ হল। প্রেসিডেন্ট ১৭ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর লেঃ জেঃ টিক্কা খানকে সার্বিক প্রস্তুতি নিতে দিক নিদের্শনা দেন। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সবার অজান্তে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট পিআইএর বিমানে করাচীর উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। স্বাধীনতার দাবিতে বাঙালির কন্ঠ স্তব্দ করার জন্য অপারের্শন সার্চ লাইট বাস্তবায়নের পরিকল্পনা হয়, প্রেসিডেন্ট তা অনুমোদন করেন। ঢাকার বাইরে এ অপারেশনের বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তা মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা’র ওপর।

খুলনা জেলা তখন যশোর সেনানিবাসের অধীনে। জেঃ রাজা যশোর সেনানিবাসের জিওসি মেজর জেনারেল এম এইচ আনসারীকে ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চ লাইট বাস্তবায়নে সরকারী সিদ্ধান্তের কথা জানান। তার আগেই খুলনা সার্কিট হাউজে পাকিস্তানী সেনা সদর দপ্তর স্থাপন হয়। এ সদর দপ্তরের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল শামস উল জামান। এ সেনা কর্মকর্তাকে খুলনার অপারেশন সার্চলাইট বাস্তবায়ন করে রিপোর্ট যশোর সেনানিবাসে পাঠানোর জোর তাগিদ দেয়া হয়।

খুলনা সেনা সদর দপ্তরে পাঠানো নিদের্শনায় বলা হয়, শহরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নারী পুরুষকে হত্যা, তাদের বাড়ি ঘর, সম্পদে অগ্নিসংযোগ, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, গল্লামারী বেতার ভবন দখল, নতুন বাজার এলাকায় ইপিআর এর সদর দপ্তর (আজকের খুলনা আঞ্চলিক ব্যাপটিস্ট চার্চ সংঘ), মুন্সিপাড়ায় পুলিশ লাইন এবং ভূতের বাড়ি আনসার ক্যাম্পে বাঙালিদের নিরস্ত্র করা, স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের সক্রিয় নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা। সে সময়কার উল্লেখযোগ্য আওয়ামী লীগ নেতারা হচ্ছেন শেখ আব্দুল আজিজ, সালাহউদ্দীন ইউসুফ, মমিনউদ্দীন আহমেদ, মো. মোহসিন, মো. হাবিবুর রহমান খান,

এ্যাডভোকেট মো. এনায়েত আলি, ডাঃ মুনসুর আলী, এম এ বারী, মির্জা খয়বার হোসেন, শ্রমিক নেতা অধ্যাপক আবু সুফিয়ান, ইউনুস আলী ইনু, যুবনেতা শেখ কামরুজ্জামান টুকু, মোশাররফ হোসেন, বিনয় ভূষণ চ্যাটার্জী, ছাত্রলীগ নেতা নজরুল ইসলাম, জাহিদুর রহমান জাহিদ, স ম বাবর আলী, হুমায়ুন কবীর বালু, আব্দুস সালাম মোড়ল, সুশান্ত কুমার নন্দী, ফ ম সিরাজ, ইঞ্জিনিয়ার আবুল কাশেম, ইস্কান্দার কবীর বাচ্চু, মাহাবুব উল আলম হিরণ, গাজী রফিকুল ইসলাম, হাসিনা বানু শিরিন, শেখ শহিদুল ইসলাম, শেখ আব্দুল কাইয়ুম প্রমুখ।

আইন শৃংঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে ২৫ মার্চ সকালে খুলনা সার্কিট হাউজে পাকিস্তান বাহিনীর স্থানীয় অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল শামস উল জামান পুলিশ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে তখনকার পুলিশ সুপার আব্দুর রকিব খন্দকার (পরবর্তীতে পুলিশরে আইজি) ডিএসপি মফিজ উদ্দীন, সহকারী পুলিশ সুপার আজাহার হোসেন চৌধুরীসহ পুলিশের অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পাকিস্তানী এই সামরিক কর্মকর্তা বৈঠকে জানান, প্রেসিডেন্ট ২৬ মার্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। তিনি পরামর্শ দেন আইন শৃংঙ্খলা পরিস্থিতির যেন অবনতি না ঘটে (সাব সেক্টর কমান্ডার এ এস এম শামছুল আরেফিন রচিত মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের ভূমিকা)।

৩ মার্চ স্টেট ব্যাংক, খুলনা শাখার সামনে বেলুচ পুলিশের গুলিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে স্বাধীনতা প্রত্যাশীদের মিছিলে আটজন নিহত হওয়ায় শহরবাসী পাকিস্তানী সৈন্যদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। সার্কিট হাউজ, কালক্টরেট ভবন ও জেলা জজ আদালত ছাড়া শহরের সর্বত্র কালো পতাকা ওড়ে। ২৩ মার্চ হাদিস পার্কে স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে শহরে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। পাকিস্তান বাহিনী ইউডিএফ ক্লাব (আজকের অফিসার্স ক্লাব), গল্লামারী রেডিও সেন্টার, নুরনগর, শিপইয়ার্ড, পিএমজি ও রুজভেল্ট জেটি এলাকা, খালিশপুর পিপলস জুট মিলে অবস্থিত পুলিশ ফাঁড়িতে সেনা ছাউনী ফেলে। পিপলস জুট মিলস্ এলাকার পুলিশ ফাঁড়ির দায়িত্বে ছিলেন বাদশা খান নামক একজন সুবেদার, তিনি অবাঙালি। শিল্পাঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে খবরা খবর নেয়ার জন্য এই ফাঁড়িতে ওয়ারলেস সেট থাকতো। শহরের পরিস্থিতি জানার জন্য ২৫ মার্চ রাত আনুমানিক তিনটার দিকে ওয়্যারলেস অপারেটর আফিলউদ্দিন ওয়্যারলেস চালু করেন।

এ সময় জেলা পুলিশ ওয়্যারলেস অপারেটর গাজী ময়েনুদ্দীন শিল্পাঞ্চলের অপারেটরকে জানান, পাকিস্তানী সেনারা জেলা পুলিশ ওয়্যারলেস অফিস আক্রমণ করেছে। তাছাড়া জেলা পুলিশ সুপার আব্দুর রকিব খন্দকারকেও গ্রেফতার করে। এ খবর পাওয়ার পর পিপলস জুট মিলস পুলিশ ফাঁড়ির সুবেদার বাদশা খানকে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা বন্দী করে। চল্লিশটি রাইফেল ও পনের বক্স গুলি বাঙালি পুলিশরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে। দশজন পুলিশ ও মিলের নিরাপত্তা প্রহরীরা সিকিউরিটি অফিসের ওপর বালির বস্তা দিয়ে বাংকার তৈরী করে। পুলিশ ফাঁড়ির অস্ত্র বাঙালি পুলিশদের নিয়ন্ত্রণে এ খবর মুহূর্তের মধ্যে সার্কিট হাউজ সদর দপ্তরে পৌঁছে যায়। ২৬ মার্চ সকাল আনুমানিক ১০টা নাগাদ সার্কিট হাউজ সদর দপ্তর থেকে সেনাবাহিনীর একটি দল পিপলস জুট মিলে প্রবেশের চেষ্টা করে। মিলের অভ্যন্তরে অবস্থান নেয়া বাঙালি পুলিশ ও নিরাপত্তা প্রহরীরা সেনাবাহিনীকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়।

খুলনা গেজেট/ টিএ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!