নেতাজীকে নিয়ে সাধারন মানুষের আবেগ, ভালোবাসা যতদিন যাচ্ছে বেড়েই যাচ্ছে । কারণ তার নিখাঁদ দেশপ্রেম নিয়ে কোন বিতর্ক নেই সাধারন মানুষের মধ্যে। তাকে নিয়ে নানান গল্প চুম্বকের মত আকর্ষণ করে মানুষকে আজও । আপামর মানুষের চোখে নেতাজী হলেন এমন একজন ‘যাকে চোখ বুজে বিশ্বাস করা যায়’। তাঁকে নিয়ে উচ্ছাসের শেষ নেই । অনেকেই এই বিশ্বাস নিয়ে চলেন যে, নেতাজী দেশ পরিচালনার সুযোগ পেলে দেশটার ভাঙ্গনটা নিশ্চ্য় ঠেকাতে পারতেন । পরাধীন দেশে নেতাজির ডাকে অগণিত মানুষ সমস্ত স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে স্বদেশী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। পুলিশের আক্রমণ, নির্যাতন, মৃত্যুভয় কোনকিছুই তাদের ঘরে আটকে রাখতে পারে নি। এমনি ছিল তাঁর জনমোহিনী ক্ষমতা । ১২৫তম জন্মবার্ষিকীতে এসেও তাঁকে নিয়ে উচ্ছাস, ভালোবাসা, উন্মাদনার শেষ নেই । তাঁকে নিয়ে অনেক প্রশ্নের উত্তর পায়নি মানুষ । অমীমাংশিত বিষয়গুলি নিস্পত্তির পথ মানুষ ঠিক খুঁজে নেবেন । এই প্রবন্ধে নেতাজীর অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার একটা প্রাথমিক ধারণা আলোচনা করব ।
১৯৩০ সালে বিপ্লবী বারিন্দ্র ঘোষকে লিখেছিলেন- “… আমরা শুধু জনগণকে রাজনৈতিক শৃংখল থেকেই মুক্ত করব তা নয়, আমরা তাদের সব রকম শৃংখল থেকে মুক্ত করবো। স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্য হবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক তিন ধরনের অত্যাচার থেকে মুক্ত করা। যখন সব ধরনের শৃংখল দূর করা যাবে তখন কমিউনিজমের ভিত্তিতে নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যাবে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল লক্ষ্য হবে শ্রেণীহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করা” । তিনি দেশকে বিদেশি শাসনের শৃংখল থেকে মুক্ত করতে চেয়েছেন । একই সাথে চেয়েছেন দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষ্য, বন্যা, মারি-মড়ক, অন্যায়, অনাচার, অবিচার, কুসংস্কার, অশিক্ষা, অজ্ঞতা, অত্যাচার ও শোষণের নাগপাশ থেকে দেশের সাধারণ মানুষকে মুক্ত করতে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোনো অর্থ হয় না । তাই তিনি রাজনৈতিক সংগ্রামের কার্যসূচি গ্রহণ করার সময়ে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যসূচিও ঘোষণা করেছেন। তিনি একটা সুনির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েই স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রাম শুরু করেছিলেন । তিনি ঘোষণা করেছিলেন, “কংগ্রেসের প্রথম লক্ষ্য দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন, পরের লক্ষ্য সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা”। ১৯৩৩ সালে লন্ডনে ভারতীয়দের সর্বদলীয় সম্মেলনে তাকে সভাপতিত্ব করার আমন্ত্রণ জানানো হয় । ইংরেজরা ওদেশে যাবার অনুমতি না দেওয়ায় সম্মেলনে তার পাঠানো লিখিত ভাষণ পাঠ করা হয়েছিল । ভাষণে তিনি লিখেছিলেন – স্বাধীন ভারত পুঁজিপতি, জমিদার এবং বর্ণবাদীদের রাজ্য হবে না । ১৯৩৮ সালে ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব রজনীপাম দত্তের সাথে সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন – আমরা প্রথমে জাতীয় স্বাধীনতা চাই । তারপরে আমরা সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাব । ১৯৪২ সালে একটি জার্মান পত্রিকায় তিনি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রূপরেখা দিয়েছিলেন ।
১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি হবার পর ভাষণে তিনি ‘জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি’ গঠনের কথা বলেছিলেন । জাতীয় পরিকল্পনা কমিটির চেয়ারম্যান করা হয় নেহেরুকে । এই কমিটিতে দল-মত নির্বিশেষে বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, শিল্পপতি, অর্থ বিনিয়োগকারী, অধ্যাপক, ট্রেড ইউনিয়ন ও গ্রামীণ শিল্পের প্রতিনিধি, কংগ্রেস এবং অকংগ্রেস শাসিত প্রাদেশিক সরকার ও কতগুলি দেশীয় রাজ্যের প্রতিনিধিদের সদস্য হিসাবে রাখা হয়েছিল । জাতীয় পরিকল্পনা কমিটি গঠন করার কয়েকটি উদ্দেশ্য হলো – (১) বিদেশি পুঁজির হাত থেকে মুক্ত করে দেশের অর্থনীতিকে সরকারের অর্থাৎ জনসাধারণের নিয়ন্ত্রণ করা (২) স্বাধীন হওয়ার পরে স্বাধীন সরকার যাতে দ্রুত দেশের পুনর্গঠনের এবং শিল্পায়নের কাজে হাত দিয়ে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদির মতো মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধান করতে চেষ্টা করে । তিনি আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক শিল্পনীতির পরিবর্তে সর্বভারতীয় শিল্প নীতি প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ঐ বছরেই বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস মন্ত্রিসভার শিল্প মন্ত্রীদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটা সম্মেলন ডাকেন । উদ্বোধনী ভাষণে বলেছিলেন “কংগ্রেস কর্মীদের আজ শুধু স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করলেই চলবে না, জাতীয় পূনর্গঠনের বিষয়েও কিছু চিন্তা শক্তি ব্যয় করতে হবে”। রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে, পরিচালনায় বা নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা অনুসারে ভারত সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখে সেটা রূপায়িত করার চেষ্টা করুক – এই ছিল তার মত। সুভাষচন্দ্র কংগ্রেসের কর্মসূচির মধ্যে ভূমি ব্যবস্থার ব্যাপক সংস্কার, জমিদারি প্রথা বিলোপ, কৃষি ঋণ মুকুব, সমবায় প্রথার বিস্তার, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, শিল্পায়নের জন্য ভারি বড় যন্ত্র শিল্প স্থাপন, দেশী ও বিদেশী ঋণ গ্রহণ, রাষ্ট্রীয় মালিকানায় কৃষি ও শিল্পের বিকাশ ইত্যাদি কাজকে অর্ন্তভুক্ত করেছিলেন । ব্যক্তিগত সম্পত্তির উপরে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার পরে আবার সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার কথা তিনি বলেছেন । তার মনে হয়েছিল শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় মালিকানা থাকলে তাতে আমলাতান্ত্রিকতার ঝোঁক চলে আসতে পারে কারণ আমলারা জনপ্রতিনিধি নয় । রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে সমাজতান্ত্রিক মালিকানায় পরিণত করতে পারলে সেটা আমলাতন্ত্রের কুক্ষিগত না হবার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।
যদি দেশ থেকে দারিদ্র ও বেকার সমস্যা দূর করতে হয়, তাহলে রাষ্ট্রের পরিচালনায় শিল্পায়ন ও কৃষিতে উৎপাদনের ব্যবস্থা করতেই হবে । স্বাধীন ভারতের সরকারকে শ্রমিকদের জন্য দিতে হবে উপযুক্ত বেতন, রোগ নিরাময়ের সুযোগ, দুর্ঘটনার ক্ষতিপুরণ ইত্যাদি । এছাড়াও অত্যধিক কর ভার ও ঋণের জাল থেকে কৃষককে মুক্তি দিতে হবে ।
লেখকঃ সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ