ছাত্রদল নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের পথ অনুসরণ করছে মন্তব্য করে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেছেন, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে বন্ধুপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলকে তাদের পথ অনুসরণ করতে দেখা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা অত্যন্ত উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করছি, ছাত্র রাজনীতি নিয়ে যে জনাকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল তা কিছু ছাত্রসংগঠনের আধিপত্যনীতি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, চাঁদাবাজি, দখলদারি, ট্যাগিং ও দোষ চাপিয়ে দেওয়ার হীন সংস্কৃতি চালু রাখার ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের মধ্যে রাজনীতি বিমুখতা তৈরি এবং শিক্ষার পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
রোববার (২৩ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন শিবির সভাপতি।
তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে সব রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনসমূহের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহযোগিতা ও সহাবস্থান নিশ্চিত করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখা সবার দায়িত্ব। কিন্তু আমরা লক্ষ করছি বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্রদল ছাত্রশিবিরসহ অন্যান্য ছাত্রসংগঠনকে অন্যায়ভাবে দমনের চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, নিজেরা সন্ত্রাসী কায়দায় শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে তার দায় উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে, যার প্রবক্তা ছিল নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগ।
স্বৈরাচারী, গণহত্যাকারী শেখ হাসিনামুক্ত বাংলাদেশেও ফ্যাসিবাদের টুলসগুলো কিছু ছাত্রসংগঠন ঘোষণা দিয়ে গ্রহণ করেছে। আপনারা দেখেছেন, তারা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে ‘শিবির কোবানো/কোপানো জায়েজ আগেও ছিল এবং ভবিষ্যতেও থাকবে’ এমন বীভৎস ঘোষণা দিচ্ছে। আমরা নোয়াখালীতে এমন একজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। আমরা আশা করব সরকার তার বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে।
জাহিদুল ইসলাম বলেন, শুধু তাই নয়, কুয়েটের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্রশিবিরের সম্পৃক্ততার মিথ্যা বক্তব্য দিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ করে। খুলনার শিববাড়িতে তাদের মিছিল থেকে ‘একটা একটা শিবির ধর, ধইরা ধইরা জবাই কর’ এই স্লোগান দেওয়া হয়। এমন ভয়ংকর, হিংস্র স্লোগান আমরা ছাত্রলীগের মুখে শুনতাম। কিন্তু ছাত্রদলের মধ্যে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, সারা দেশে শত শত জায়গায় চাঁদাবাজি, দখলদারি দেখে বোঝার উপায় নেই, দেশে কোনো পরিবর্তন হয়েছে। অপরাধীদের হাত বদল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু অপরাধ আগের মতোই চলছে। গত ২২ ফেব্রুয়ারি যশোরে চাঁচড়ায় চাঁদা না দেওয়ায় সম্রাট নামের এক মাছা ব্যবসায়ীর চোখ উপড়ে ফেলে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা। গতকাল গাজীপুরে মাইকে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে চাঁদা আদায় করার ঘটনা আপনারা দেখেছেন। প্রতিদিন এমন অসংখ্য ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে।
শিবির সভাপতি বলেন, সম্প্রতি কুয়েট, এমসি কলেজ ও গত ২০ ফেব্রুয়ারি তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসায় যে হামলার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তা একটি ছাত্রসংগঠনের নব্যফ্যাসিবাদ হয়ে ওঠার ধারাবাহিকতারই অংশ বলে আমরা মনে করছি। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপর ছাত্রদল যুবদলের বহিরাগত সন্ত্রাসীদের নিয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে পরিকল্পিতভাবে সশস্ত্র হামলা পরিচালনা করে।
যেখানে অর্ধশতাধিক শিক্ষার্থী মারাত্মকভাবে আহত হয়। কিন্তু ছাত্রদল তাদের উচ্ছৃঙ্খল কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো সেই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দায় ছাত্রশিবিরের ওপর চাপিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, প্রকাশ্য সংবাদ সম্মেলনে ছাত্রদল সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব শিবিরের ওপর দায় দিয়ে দেওয়ার নির্দেশনা প্রদান করে, যার মাধ্যমে দেশবাসীর কাছে তাদের ঘৃণ্য পরিকল্পনা স্পষ্ট হয়ে যায়।
তিনি আরও বলেন, একদিকে ছাত্রশিবিরের ওপর দায় চাপিয়ে প্রকৃত ঘটনাকে আড়াল করতে চেষ্টা করে, অন্যদিকে যুবদল তাদের চিহ্নিত সন্ত্রাসীকে বহিষ্কার করার মাধ্যমে নিজের সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ হয়ে যায়। এ ঘটনায় দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে তা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সিলেটের এমসি কলেজে আনযুমানে তালমীযে ইসলামিয়ার কর্মী মিজানুর রহমান রিয়াদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের হাতাহাতির ঘটনায় দুজন (জাহিদুল ইসলাম হৃদয় ও রিয়াদ) আহত হওয়ার দায় ছাত্রশিবিরের ওপর প্রদান করে। পরবর্তীতে কলেজ অধ্যক্ষের বক্তব্যের মাধ্যমে প্রকৃত ঘটনা প্রকাশ পেলে ছাত্রশিবির যে সেই ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়, তা প্রমাণিত হয়।
টঙ্গীর ঘটনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, কুয়েটে শিক্ষার্থীদের রক্তের দাগ শুকাতে না শুকাতেই গত ২০ ফেব্রুয়ারি টঙ্গীতে তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদরাসার শিক্ষার্থী ও ছাত্রশিবিরের ওয়ার্ড সভাপতি ফজলে রাব্বি সিফাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে ছাত্রদলের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জখম করে। শুধু তাই নয়, জোরপূর্বক নিজেদের পক্ষে স্বীকারোক্তি নিতে একাধিকবার ছাত্রদল কর্মীরা নির্যাতন করে।
আসামিকে ছিনিয়ে নিয়ে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে বক্তব্য নিতে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা থানার সামনে মব তৈরি করার চেষ্টা করে। আমরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত সবাইকে গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে প্রশাসনের কাছে দাবি পেশ করছি। পাশাপাশি হামলার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে ছাত্রদলের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সাত মাস অতিক্রান্ত হলেও এখনও দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে এখনও দেশে নানা প্রান্তে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। সারাদেশে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি ও ধর্ষণের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে। উদ্বেগের বিষয় হলো, গণমাধ্যমের রিপোর্ট অনুযায়ী দেশে ২৭৩টি কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানা ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলেও তাদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে না।
গণমাধ্যম সূত্রে জানতে পেরেছি, জুলাই গণহত্যায় জড়িতদের ৭২৩ জনকে জামিন দেওয়া হয়েছে, অথচ বিগত পনেরো বছরের দায়েরকৃত মামলার আসামিদেরকে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে না। আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি এটিএম আজহারুল ইসলামসহ সকল মজলুমদের দ্রুত মুক্তির দাবি করছি।
শিবির সভাপতি আরও বলেন, আপনারা জানেন, সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার জলমা ইউনিয়ন, শেরপুর জেলার ঝিনাইগাতীর গজনী অবকাশ কেন্দ্র ও রাজধানী থেকে ছেড়ে যাওয়া রাজশাহীগামী একটি বাসে তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা নারীসহ তিনটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। আমরা ধর্ষকদের গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও প্রশাসনকে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। অথবা নিজেদের ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে জাতির নিকট ক্ষমা চাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।
এছাড়াও তিনি বলেন, আমরা লক্ষ করেছি, মুক্ত চিন্তার নামে এ দেশে ইসলামবিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়িয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে। সেই গোষ্ঠীরই এক ক্রীড়নক জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)-এর পাঠ্যবই সংশোধন ও পরিমার্জন কমিটির সদস্য রাখাল রাহা (সাজ্জাদুর রহমান) আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-এর শানে চরম অবমাননাকর ও ধৃষ্টতাপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করে একটি ফেসবুক পোস্ট দিয়ে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে যা ফৌজদারি আইন লঙ্ঘনের শামিল। আমরা অতি দ্রুত তাকে গ্রেপ্তার করে শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।
শিবির সভাপতি বলেন. পারস্পরিক সহযোগিতা ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মাধ্যমে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন সবার বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের চতুর্থস্তম্ভ গণমাধ্যমের ও জাতির বিবেক সংবাদকর্মীদের ভূমিকা অপরিহার্য। জুলাই অভ্যুত্থানে সব পক্ষ এক মোহনায় মিলিত হওয়ার ফলেই আমরা চেপে বসা পাহাড়সম জগদ্দল পাথরকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু ফ্যাসিবাদ পরবর্তী বাংলাদেশে কতিপয় গণমাধ্যমের অপেশাদারি আচরণ আমাদের ব্যথিত করেছে। কিছু কিছু সংবাদ আমাদের কাছে একপেশে বলে প্রতীয়মান হয়েছে। আমরা মনে করি এগুলো মিডিয়ার ইচ্ছাকৃত ভুল নয়, অসাবধানতা বা তথ্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া পুরোপুরি অনুসরণ করতে না পারার দরুন এমনটা হয়েছে।
গত ১ জানুয়ারি, বরগুনার পাথরঘাটায় পূর্ব শত্রুতার জেরে যুবদল কর্মী ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন। স্থানীয় মিডিয়া এবং পাথরঘাটা বিএনপির আহ্বায়ক উমর ফারুক সেই ঘটনার সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীকে দায়ী করে। কিন্তু আমরা লক্ষ করি, জাতীয় একটি সংবাদমাধ্যম সেই ঘটনার তথ্য যাচাই-বাছাই না করেই ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে সংবাদ প্রচার করে।
একইভাবে কুয়েটের ঘটনাতেও আমরা লক্ষ করেছি, শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের সংঘর্ষের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা না থাকলেও ছাত্রশিবিরকে দায়ী করে প্রতিবেদন প্রচার করা হয়। সিলেটের এমসি কলেজের ঘটনাতেও কতিপয় সংবাদমাধ্যম উদ্দেশ্যমূলকভাবে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। এছাড়াও আরও একাধিক ঘটনায় ছাত্রশিবিরকে জড়িয়ে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে, অথচ ছাত্রশিবিরের সঙ্গে এ সব ঘটনার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও বলেন, আমরা সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ক্যাম্পাস হামলার শিকার শিক্ষার্থীদের জন্য ন্যায়বিচার দাবি করছি। এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি, যাতে তারা এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির তাৎক্ষণিক উন্নতির জন্য সরকারকে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। আমরা জোর দিয়ে বলছি যে, ধর্মীয় অবমাননা এবং সাম্প্রদায়িক সহিংসতার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে ছাত্রদলসহ সব ছাত্রসংগঠনকে বিভাজন সৃষ্টিকারী, দোষারোপ ও সহিংসতা পরিহার করে ছাত্রবান্ধব, গঠনমূলক ও কল্যাণমুখী রাজনীতির দিকে আহ্বান জানাচ্ছি।
খুলনা গেজেট/ টিএ