মধু মানুষের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত এক অপূর্ব নিয়ামত। মধু খাদ্য ও ওষুধ এবং উভয়বিধ পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ। ফলে স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং যাবতীয় রোগ নিরাময়ে মধুর গুণ অপরিসীম। যে কারণে সুন্দরবনের খাটি মধুর চাহিদা রয়েছে সর্বত্র। খাটি মধুর এই চাহিদার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ি চিনি জ্বালিয়ে রাতারাতি তৈরি করছে শতশত মণ মধু। কদাচিৎ দু’চারটি ভেজাল মধুর চালান আটক হলেও ঠেকানো যাচ্ছে না অনৈতিক এ তৎপরতা। যদিও বনবিভাগসহ আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দাবি ভেজাল মধু উৎপাদন বন্ধে দরকার স্থানীয়দের সচেতনতা।
এদিকে আগামীকাল পহেলা এপ্রিল থেকে বনবিভাগের পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের মধু সংগ্রহের নির্দেশনা রয়েছে। তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই বাজারে চলে এসেছে সুন্দরবনের সে মধু। বেশি মুল্যের আশায় মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাশ নিয়ে জেলের বেশে স্থানীয়রা বনে ঢুকে সংগ্রহ করছে এসব মধু। এলাকায় এনে বিক্রি করছে চড়া দামে। ফলে নির্দিষ্ট সময়ে সুন্দরবনে যেয়ে কাংখিত পরিমাণ মধু না পাওয়ার শংকার কথা জানিয়েছে মৌয়ালরা। এছাড়া আগেভাগে অপরিণত চাক কাটার দরুণ মধুর উৎপাদন কমে যাওয়ার অভিযোগ তাদের।
পশ্চিম সুন্দরবনসংলগ্ন বুড়িগোয়ালীনি, হরিনগর, কালিঞ্চি ও কৈখালী এলাকার বনবিভাগসহ স্থানীয় গ্রামবাসী ও মৌয়ালদের সাথে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে। ভেজাল মধুর সরবরাহ রুখতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগসহ সুন্দরবনসংলগ্ন গ্রামগুলোতে মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারের দাবি করেছে তারা।
শ্যামনগর উপজেলার নীলডুমুর গ্রামের আব্দুল খালেক জানান, মধু সংগ্রহ করতে মৌয়ালরা আগামীকাল পহেলা এপ্রিল সোমবার সুন্দরবনে প্রবেশে বনবিভাগের অনুমতি (পাশ) পাবে। অথচ মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে তাদের এলাকাসহ মুন্সিগঞ্জ ও হরিনগরে ১২০০ থেকে ১৪০০ টাকায় প্রতি কেজি সুন্দরবনের মধু বিক্রি হচ্ছে। মুলত বেশি মুল্যের আশায় মাছ শিকারের অনুমতি নিয়ে সুন্দরবনে যাওয়া জেলেরা এসব মধু সংগ্রহ করছে। ফলে কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট করে দেয়া সময়ে বনে ঢুকে প্রত্যাশিত পরিমাণ মধু সংগ্রহ নিয়ে চিন্তায় পড়েছেন মৌয়ালরা।
প্রায় তিন দশক ধরে মধু সংগ্রহের কাজে জড়িত হরিনগর গ্রামের আইয়ুব আলী বলেন, সুন্দরবনের মধুর সুখ্যাতির সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কতিপয় অসাধু ব্যক্তি বাজারে ভেজাল মধু সরবরাহ করছে। নানা অজুহাতে সুন্দরবনে প্রবেশের পর সঙ্গে নিয়ে যাওয়া চিনি জ্বালিয়ে মধুর সাথে মিশিয়ে লোকালয়ে ফিরছে তারা। আবার কতিপয় দাদন ব্যবসায়ী বাড়িতে গড়ে তোলা কারখানায় জ্বালানো চিনির সাথে সংগৃহীত মধু মিশিয়ে পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করছে। এভাবে ভেজাল মধু বাজারজাতকরণে সুন্দরবনের মধু গুরুত্ব হারাচ্ছে বলেও দাবি তার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালে ট্যাস্কফোর্সের অভিযানে শ্যামনগর উপজেলার সিংহড়তলী গ্রামের রাশিদুল ইসলামের দোকানসহ ছোট ভেটখালীর নজরুল ইসলাম ও আব্দুল বারিকের বাড়ি থেকে ভেজাল মধুভর্তি ১৪৭টিরও বেশি ড্রাম জব্দ করা হয়। এছাড়া ঢাকায় নেয়ার পথে শ্যামনগরের ইসমাইলপুর থেকে প্রায় একশ মণ মধু আটকের পাশাপাশি মথুরাপুর গ্রামের আব্দুর রশিদ ওরফে চিনি রশিদের বাড়িতে গড়ে তোলা মধুু তৈরীর কারখানা আবিস্কার করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। প্রায় একই সময়ে মীরগাং গ্রামের বিজয় ও বিমল মন্ডলকে পাঁচশ লিটার ভেজাল মধুসহ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে শ্যামনগর থানা পুলিশ। সাতক্ষীরা শহরের সুলতানপুর ও পলাশপোল এলাকায় পৃথক অভিাযানে বিপুল পরিমাণ ভেজাল মধু জব্দ করে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।
কিছু অসাধু ব্যবসায়ি কর্তৃক ভেজাল মধু তৈরির কথা স্বীকার করে পশ্চিম সুন্দরবনের সহকারী রেঞ্জার নুর আলম বলেন, গত বছর সুন্দরবনের মধ্যে ঢুকে ভেজাল মধু উৎপাদনের অভিযোগে পাঁচটি নৌকাসহ ২৮ জনকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছিল। তবে লোকালয়ের ভেজাল মধু উৎপাদনকারীদের ধরতে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে থাকে। ভেজাল মধু তৈরির সাথে জড়িতদের চিহ্নিত করতে স্থানীয়দের সর্বাধিক ভূমিকা পালনের প্রয়োজন-উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বনবিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু অসাধু ব্যক্তি কর্তৃক আগেভাগে সুন্দরবনের মধু সংগ্রহের অভিযোগ সত্য। তবে এই অপতৎপরতা রুখতে আমরা চেষ্টা করছি বলে জানান ওই বন কর্মকর্তা।
খুলনা গেজেট/এনএম