পরম শ্রদ্ধেয় দৈনিক অনির্বাণের সম্পাদক অধ্যক্ষ আলী আহমেদ চলে গেছেন জীবনের অনিবার্য গন্তব্যে। শত-সহস্র মনের আকাশে আলো জ্বালানো, পথ দেখানো আমাদের বাতিঘরের আলো নিভে গেছে। তিনি প্রায় অর্ধশত বছর ধরে খুলনাঞ্চলের সাংবাদিকতা ও সংবাদ পত্র জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র ছিলেন। দৈনিক সংবাদপত্র সম্পাদনা ও তার পাশাপাশি অধ্যাপনা, রাজনীতি, সমাজ সেবা, উন্নয়ন ও আন্দোলন কর্মকান্ডের মধ্য দিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি।
সাংবাদিকতা জগতে প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন অধ্যক্ষ আলী আহমেদ। পরম ভালবাসা ভরা হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন তিনি। খুলনায় নতুন কেউ সাংবাদিকতা শিখতে চাইলে পাঠশালা ছিলো তার অনির্বাণ পত্রিকা। দেশের বহু খ্যাতিমান সাংবাদিক তৈরি তার অনির্বাণ পত্রিকা থেকে।
সাংবাদিকতার বাতিঘরখ্যাত জ্ঞান-তাপস অধ্যক্ষ আলী আহমেদ বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) দুপুর সাড়ে ১২টায় খুলনা মহানগরীর নার্গিস মেমোরিয়াল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। বর্ষিয়ান সাংবাদিক আলী আহমেদ বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি, খুলনা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য ছিলেন।
সাতক্ষীরা মহকুমার কলারোয়া থানার মুরারীকাটি গ্রামের ১৯৪৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন সাবেক এই সংসদ সদস্য। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাস ও সংস্কৃত বিষয়ে স্নাতকোত্তর সনদ লাভ করেন। ১৯৬৪ সালে দৈনিক পূর্বদেশের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় সংবাদদাতা হিসেবে সাংবাদিকতা পেশার সাথে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি প্রকাশিত খুলনার সাপ্তাহিক জন্মভূমির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৪ সালের পূর্বাঞ্চল দৈনিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলে তিনি নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সালে তিনি বাকশালে যোগ দেন। ১৯৭৭ সালে দৈনিক অনির্বাণ সম্পাদনা করেন। ১৯৭২-৭৮ খুলনা প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এবং ৯১-৯২ সালে সভাপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনও করেন। ১৯৮৮ ও ৮৯ সালে বাংলাদেশ এডিটরস কাউন্সিলের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
জীবনের প্রথম দিকে মুসলিম লীগের নীতি আদর্শে পরবর্তীতে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে বিএনপিতে যোগ দেন। তিনি বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ সালের বিএনপির মনোনয়নে সাতক্ষীরা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৬৫ সালের ১ জুলাই থেকে ১৯৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত এম এম সিটি কলেজে শিক্ষকতা করেন। তার অনন্য সৃষ্টি খুলনার আহসানউল্লাহ ডিগ্রী কলেজ ও খুলনা শিশু বিদ্যালয়। কলারোয়ায় মুরারীকাটি ইউনাইটেড হাইস্কুল ও খুলনা শহীদ সোহরাওয়ার্দ্দী কলেজ প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন তিনি।
সাতক্ষীরা সুন্দরবন পাবলিক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠায় জনমত গঠনে উদ্যোগ নিয়েছেন। এলজিইডি প্রতিষ্ঠায় প্রকৌশলী মরহুম কামরুল ইসলাম সিদ্দিকীর সাথে তিনি নিরলস শ্রম দেন। তিনি খুলনা আহসানউল্লাহ কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ ছিলেন।
আমার সাংবাদিকতার শুরুর দিকটায় প্রায় ৫ বছর আলী আহমেদ স্যারের পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ হয়েছে। ভালোবেসে স্যার আমাকে ডাকতেন খোকা বলে। স্যারের সাথে অনেক স্মৃতি আমার। পত্রিকার নানা টানা-পোড়েন গেলেও স্যার ৫ বছরে এক টাকাও বেতন বকেয়া রাখেন নি আমার। স্যারের পরিবারের সাথে আমার পারিবারিক সম্পর্ক ছিলো। আলী আহমেদ স্যার ছিলেন আমার শ্বশুর অবসরপ্রাপ্ত জনতা ব্যাংক কর্মকর্তা শেখ আব্দুস সালামের শিক্ষক। আমার শ্বশুরের কাছ থেকে শুনেছি সরকারি সিটি কলেজের অনেক শিক্ষার্থী যাদের আলী আহমেদ স্যারের ক্লাস নেই তারাও ক্লাস রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো শুধু স্যারের অসাধারণ লেকচার শোনার জন্য।
রাতে ডেস্কে থাকাকালিন সময় মাঝে মাঝে তৎকালীন দৈনিক অনির্বাণের বার্তা সম্পাদক মিজানুর রহমান মিলটন ও ব্যবস্থাপক মো. আবুল হাসানকে ফোন দিয়ে আমাকে দোতলায় ডেকে নিয়ে যেতেন। এবং স্যার বলতেন আমি লিখতাম। অনেক সময় স্যার আমাকে দিয়ে লেখাতেন শুধুমাত্র আমাকে শেখানোর জন্য। যা ছিলো ইতিহাসের বিভিন্ন বিষয়। স্যারের সাথে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি। দেখেছি স্যারের অসংখ্য শিক্ষার্থী, ভক্ত ও অনুরাগীদের স্যারের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে।
মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীল মূল্যবোধ আর মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মানুষ আলী আহমেদ খুলনাঞ্চলের সাংবাদিকতা জগতে প্রতিষ্ঠানতুল্য ব্যক্তিত্ব। ষাটের দশকে সাংবাদিকতা শুরু করার পর একটানা পাঁচ দশকের বেশি সময় তিনি এ পেশায় মেধা, যুক্তিবোধ, পেশাদারিত্ব, দায়িত্বশীলতা, অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার নিরবচ্ছিন্ন চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে এবং দেশের সংবাদপত্রকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। যা এ কালের সাংবাদিকতায় বেশ বিরল। অনেক সম্পাদক আছেন যারা নিজেরা বছরে একটা সম্পাদকীয়ও লেখেন না। কিন্তু আলী আহমেদ ছিলেন এদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তিনি যেমন জানতেন তেমন লিখতেন বিভিন্ন বিষয়ে। তিনি অত্যন্ত উদার ও নরম মনের মানুষ ছিলেন। খুব কাছ থেকে তার এসব বিষয় আমি দেখেছি। তিনি ছিলেন একজন সুবক্তা। তার গায়ের রং কালো থাকায় তিনি প্রায় বলতেন , ককিলা কালো বলে গান শোনে না কে? দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনে পেশাগত দায়বদ্ধতায় তিনি ৪৪ বছর ধরে তার সম্পাদিত পত্রিকা প্রকাশ করেছেন। তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রয়াস দৈনিক অনির্বাণ পত্রিকা।
খুলনার সংবাদ পত্র জগতে সমসাময়িক সময়ে তিনটি তারকা ছিলেন- একুশে পদকপ্রাপ্ত দৈনিক জন্মভূমির সম্পাদক ও প্রকাশক হুমায়ুন কবীর বালু, দৈনিক পূর্বাঞ্চলের সম্পাদক ও প্রকাশক আলহাজ্ব লিয়াকত আলী এবং দৈনিক অনির্বাণের সম্পাদক ও প্রকাশক অধ্যক্ষ আলী আহমেদ। তিনজন ছিলেন বন্ধুর মতো। একে একে তিনজনই ঝরে গেলেন খুলনার সংবাদ পত্রের আকাশ থেকে।
আলী আহমেদ ছিলেন আলোর ফেরিওয়ালা। ছড়াতেন শিক্ষার আলো। সে আলো, সে পদধুলি যেখানটায় পড়েছে সেখানটাই আলোকিত হয়েছে। মানুষ গড়ার ক্লান্তিহীন এক বিরল কারিগর ছিলেন তিনি। তাকে হারিয়ে ফেললাম। একজন শিক্ষকের মৃত্যু নেই। এক প্রদীপ থেকে হাজার প্রদীপে আলো জ্বালান একজন আদর্শ শিক্ষক। আর এভাবেই একজন শিক্ষক বেঁচে থাকেন উত্তর-প্রজন্মে, আসন করে নেন হাজারো ছাত্রছাত্রীর হৃদয়মাঝে। ওপারে ভাল থাকুন স্যার। মহান আল্লাহর নিকট আপনার জন্য বেহেস্তের প্রশংসিত স্থানে আসন প্রার্থনা করছি।
লেখক- খুলনা ব্যুরো এডিটর, বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম ও সহকারী সম্পাদক, খুলনা প্রেসক্লাব।
খুলনা গেজেট/ এস আই