নব্বইয়ের দশকে সাবেক সোভিয়েট ইউনিয়নের সমাজতন্ত্র ভেঙ্গে পড়ার পর বিশ্বের ক্ষমতার ভারসাম্যে ওলটপালট হয়েছে। বিশ্ব পুঁজিবাদ সমাজতন্ত্র ভাঙ্গার সাফল্যের উত্তেজনায় ঘোষণা করে দেয় “পুঁজিবাদ ছাড়া আর কোন বিকল্প নেই”। বলা হয় “পুঁজিবাদই শেষ কথা”। যদিও এই মুহুর্তে বিশ্বপুঁজিবাদ স্বখাত সলিলে নিমজ্জমান অবস্থায় আছে। দরজা-জানালা বিহীন বন্দীশালায় বন্দীর মত অসহায় অবস্থা আজ পুঁজির।
পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদের একচ্ছত্র নিয়ন্রণাধীনে থাকা বিগত ৩০ বছর ধরে সারা পৃথিবী দেখেছে সমাজতান্ত্রিক শিবির দুর্বল হয়ে পড়লে “গণতন্ত্র”র কি করুণ হাল হয়, সাধারণ মানুষের জীবন যন্ত্রণা কতটা অসহনীয় হয়ে ওঠে। তবে লোভ-লালসা, ভোগ আর পুঁজির কাছে বন্ধক রাখা মস্তিষ্কগুলো থেমে নেই। তাঁরা পুঁজিবাদের সাফল্য ও প্রয়োজনীয়তা, পাশাপাশি সমাজতন্ত্র ও মার্ক্সবাদের অসারতা নিয়ে ধারাবাহিক ভাবে গালভরা বক্তৃতা ও আগুনঝরা প্রবন্ধ-গল্প-…অবিশ্রান্ত ধারায় সৃষ্ঠি করেই চলেছে। নানা পুরষ্কারে ভূষিত এসব চিন্তাবিদের সামাজিক বিশেষণ এরা ‘নিরপেক্ষ’। পুঁজির প্রচার যন্ত্র এই নিরপেক্ষদের একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক কারণ এদের হৃদয়, চিন্তা পুঁজির শিকলে বাঁধা ও অনুভূতিতে অন্ধবিশ্বাসের ঠুলি। এদের মাধ্যমে ৫ শতাংশের চকচকে জীবনটাই প্রচারের আলোয় উঠে আসে, ৯৫ শতাংশ মানুষের হাহাকার আড়ালেই থেকে যায়।
সোভিয়েট ইউনিয়ন প্রথম মানুষের সামনে একটা নতুন চেহারার সুন্দর শোষণহীন পৃথিবীর ছবি খাতায়-কলমে হাজির করেছিল, কারণ ১৯১৭ সালে ওখানে নভেম্বর বিপ্লব হয়েছিলো। এই বিপ্লব দেখিয়ে দিয়েছিল এমন একটা দেশ তৈরি করা সম্ভব যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান দায়িত্ব বহন করবে নিপীড়িত ও শোষিত শ্রেণীর মানুষ, যেখানে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা ও বাসস্থানের সমস্যা থাকে না। এই দেশে সংবিধান কাজের অধিকার ঘোষণা করেছিল, একই সাথে আইনি স্বীকৃতি দিয়ে তাকে সুনিশ্চিত করেছিল।
সংবিধান গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা ঘোষণা করে থেমে থাকে নি, একই সাথে তাকে সুনিশ্চিত করেছিল। এই দেশে অসহায় শিশুদের পুর্নবাসনের ব্যবস্থা করা, নিরক্ষরতার সমস্যা সমাধান করা, সম্পত্তির উপরে যৌথ মালিকানা চালু করা সম্ভব হয়েছিল এবং বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সঙ্গীত, চলচ্চিত্রের ব্যাপক বিকাশ ঘটেছিল। সমাজের সব কাজে ছেলেমেয়ের সমান সুযোগের ব্যবস্থা করা হয়েছিল । কৃষিতে রাষ্ট্রীয় ও যৌথ খামারের জন্ম হয়েছিল । এই তালিকা চূড়ান্ত নয়, পরিসর পেলে “সারা দুনিয়া কাঁপিয়ে দেওয়া দশ দিনে” নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে নতুন সমাজব্যবস্থার গোড়াপত্তন হয়েছিল তার সাফল্যের তালিকায় আরও অজস্র বিষয় সংযোজন করা সম্ভব।
নভেম্বর বিপ্লবের ইতিহাস বারবার পাঠ থেকে এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, এমন সমাজব্যবস্থা এমনি এমনি উপস্থিত হবে না মানুষের দোরগোড়ায়, তার জন্যে গড়ে তুলতে হবে নতুন ধরনের পার্টি । নভেম্বরের চেতনাকে সম্বল করে প্রতিটি দেশের নিজ নিজ পরিস্থিতিকে বিবেচনায় রেখে বিপ্লবী পার্টিগুলোতে কতকগুলো বিষয় সুনিশ্চিত করতেই হবে।
বিষয়গুলি হল – ১)পার্টি দেশের বাস্তব অবস্থা বুঝবে, সেই অবস্থাকে বিশ্লেষণ করে মানুষকে পরিচালনা করতে পারবে। ২) পার্টি লাফ মেরে পাহাড় পার হবার চেষ্টা করবে না । বরং সিড়িগুলো চিনতে পারবে ও পরপর ব্যবহার করে এগোতে থাকবে। ৩) পার্টি সংসদীয় সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে, কিন্তু সেটাকেই এক মাত্র লক্ষ্য বানিয়ে ফেলবে না। ৪) পার্টি মানুষের পাশে থাকার কাজকেই প্রধান কাজ বলে মনে করবে।
৫) পার্টির কর্মী ও নেতাদের দেখে মানুষ “মাতব্বর” না ভেবে “আপনজন” ভাববে। ৬) পার্টির শ্লোগান মানুষের অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে উঠবে। ৭) পার্টি মানুষের কাছে শেখার মানসিকতা নিয়ে তাদের সাথে মিশবে। একই সাথে মানুষের সামনেও শেখার মত বিষয় হাজির করার কাজে পারদর্শী হবে।
৮) পার্টির কাজের ধারাতে মানুষের আশা-আকাংখা প্রতিফলিত হবে। ৯) পার্টির স্বতস্ফূর্ততার জোয়ারে গা ভাসাবে না। যে কোন রকম সুবিধাবাদ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখবে । দোদুল্যমানতাকে শক্ত হাতে সামলাতে সক্ষম হবে। সবরকম বিচ্যুতির বিরুদ্ধেও নির্মম ভূমিকা গ্রহণ করতে প্রস্তুত রাখবে নিজেদের । নীতির প্রশ্নে আপোসপন্থীদের ভিড়ে হারিয়ে যাবে না, আবার আত্মসমর্পণবাদীদের দলেও ভিড়বে না।
১০) পার্টি যে কোনো ঘটনার বহিরাবরণ দেখেই বিচার করবে না, সব সময় ঘটনার অর্ন্তনিহিত সম্পর্কগুলোকে চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে । ঘটনার ভবিষ্যত গতিপথ অনুমান করার সক্ষমতা পার্টি অর্জন করতে পারবে। কারণ, পরিস্থিতির স্বতস্ফূর্ততার অপেক্ষায় অথবা বস্তুগত সময় তৈরির অপেক্ষায় বসে থাকাটা বিজ্ঞানসম্মত পদক্ষেপ হতে পারে না। ১১) ছদ্মবেশী বিপ্লবীদের ভাববাদী মুখোশ খুলে দিয়ে এদের বিপ্লববিরোধী চরিত্রকে প্রকাশ করে দিতে পারবে।
১২) নিষ্ঠাবান পার্টির মাপকাঠি মেনে পার্টি খোলাখুলি তার ভুল স্বীকার করে, ভুলের কারণ নির্ধারণ করে, কী পরিস্থিতিতে ভুল হল তার ব্যাখ্যা করে এবং এই ভুল শোধরানোর পন্থা পদ্ধতি নিয়ে পুংখানুপুংখ আলোচনা করবে।
নভেম্বর বিপ্লব যে সত্য উদ্ঘাটিত করেছে তা হল বিপ্লব অর্থাৎ সমাজ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে গেলে একটা ঐক্যবদ্ধ পার্টি প্রয়োজন। নভেম্বর বিপ্লবের আলোতেই স্পষ্ট হয়েছিল কমিউনিস্ট নামধারী সুবিধাধারীদের, সংশোধনবাদীদের প্রকৃত স্বরূপ। তাই, কমিউনিস্ট পার্টিতে কেউ ঢুকে পড়লেই সে কমিউনিস্ট বা বিপ্লবী হয়ে যায় না। প্রতিদিন লড়াই চালাতে চালাতে নিজের চেষ্টাতে নিজেকে ঐ উন্নত পর্যায়ে উন্নীত করতে হয় । একাজে পার্টি পাশে থাকতে পারে, কিন্তু সবটা নিরবচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাতে নিজেকেই করতে হয়।
লেখক : সহকারী অধ্যাপক, কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় , পশ্চিমবঙ্গ, ভারত।
খুলনা গেজেট /এমএম