ক্রমেই এগিয়ে আসছে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ বলে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের ৫৯তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আগামী ৩ নভেম্বর হবে দেশটির জন্য অনেক হিসাব মিলানোর দিন। বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসবেন, নাকি তাকে হটিয়ে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন হোয়াইট হাউসের নিয়ন্ত্রণ নেবেন- সে প্রশ্নের উত্তর মিলবে ওইদিন। কিন্তু তার আগে খেয়াল করা যাক মার্কিন নির্বাচন অনুষ্ঠানের এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দিকে। অনেকেই হয়তো খেয়াল করে থাকবেন, প্রতি চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শুধু নভেম্বর মাসের প্রথম মঙ্গলবারই অনুষ্ঠিত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটছে না। কিন্তু কেন এই নিয়ম? এর জবাব অবশ্য লুকিয়ে আছে দেশটির নির্বাচন অনুষ্ঠানের ইতিহাসের মধ্যে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ১৭৮৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর (সোমবার) থেকে ১৭৮৯ সালের ১০ জানুয়ারি (শনিবার) পর্যন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের জাতির জনক জর্জ ওয়াশিংটন সেই নির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর ১৭৯২ সালের ২ নভেম্বর (শুক্রবার) থেকে ৫ ডিসেম্বর (বুধবার) পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেখানেও জর্জ ওয়াশিংটনের পক্ষেই ভোটের রায় দেয় মার্কিন জনগণ। তবে দেশটি প্রথম প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক ভোট দেখে ১৭৯৬ সালের ৪ নভেম্বর (শুক্রবার) থেকে ৭ ডিসেম্বর (বুধবার) অনুষ্ঠিত তৃতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। সেবার ফেডারালিস্ট পার্টির জন অ্যাডামস প্রতিপক্ষ ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকান পার্টির টমাস জেফারসনকে পরাজিত করে দেশটির তৃতীয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। এরপর থেকে নির্বাচনের ধারা অব্যাহতই ছিল। কিন্তু সে সময় অঙ্গরাজ্যগুলো নিজেদের পছন্দমতো দিনে ভোট আয়োজন করায় এ নিয়ে দেখা দিত বিশৃঙ্খলা। এ ছাড়া অনেকেই বলতে শুরু করেন, সবসময় ব্যবসায়িক দিনে ভোটের দিন পড়ায় তা ভোটারদের হতাশ করে। তাই কেন নির্বাচনের জন্য বছরের এমন একটি দিন ঠিক করা হবে না, যাকে জাতীয় ছুটি ঘোষণা করা যায়। তা হলে ওইদিনে সব অঙ্গরাজ্য একসঙ্গে ভোট আয়োজন করতে পারে। এতে ভোটারদের যেমন সুবিধা হয়, তেমনি সুবিধা হয় শৃঙ্খলা আনয়নেও। সময়ের পরিক্রমায় আসে ১৮৪৪ সালের ১৫তম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেবারও পহেলা নভেম্বর (শুক্রবার) থেকে ৪ ডিসেম্বর (বুধবার) পর্যন্ত ভোট অনুষ্ঠিত হয়। ওই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হেনরি ক্লেকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জেমস কে পোলক। সেবারও নির্বাচনের দিন নিয়ে তুমুল আলোচনা হয়েছিল। তাই পোলক নির্বাচিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের একটি নির্দিষ্ট দিন ঠিক করতে সচেষ্ট হন। তার প্রচেষ্টায় ১৮৪৫ সালে প্রথম মার্কিন কংগ্রেস পার্লামেন্টে একটি ফেডারেল আইন পাস করে, যাতে সিদ্ধান্ত হয় এখন থেকে নভেম্বরের প্রথম সোমবারের পরের দিন অর্থাৎ মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এই আইন পাসের আগেও অবশ্য কম বিতর্ক হয়নি। নির্বাচনের দিন নভেম্বরের প্রথম রবিবার করারও প্রস্তাব আসে। কিন্তু রবিবার দেশটির ধর্মপ্রাণ খ্রিস্টানরা সবাই গির্জায় যায় সাপ্তাহিক প্রার্থনায় অংশ নিতে। তাই তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এরপর প্রস্তাব আসে সোমবারের। কিন্তু ১৮ শতকের মাঝামাঝি ওই সময়ে অধিকাংশ আমেরিকানই ছিলেন কৃষক। এ ছাড়া ঘোড়ার গাড়িতে এক অঙ্গরাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে যাতায়াতও ছিল কঠিন। তাই ভোট দিতে-আসতে দূর-দূরান্তের ভোটাররা যেন সময় পান, সে জন্য মঙ্গলবারকেই নির্বাচনের দিন ধার্য করে নেয়া হয়।
কেন ভোটের দিন বুধবার করা হলো না, সে নিয়েও তখন প্রশ্ন উঠেছিল। তার জবাবেও আমেরিকান কৃষকসমাজের সুবিধার কথা বলা হয়। কারণ তৎকালীন আমেরিকার কৃষকরা সারা সপ্তাহ খেটে সাধারণত বুধবার তাদের পণ্য নিয়ে বাজারে যেতেন বিক্রি করতে। সে জন্য ওইদিন ভোটের সময় নির্ধারণ করা হয়নি।
আজকের দিনে আমেরিকান সমাজের খোলস পাল্টে গেছে আমূল। কৃষির সঙ্গে সেখানে গড়ে উঠেছে আরও বড় বড় শিল্প। এ ছাড়া আমেরিকা এখন আর শুধু আমেরিকানদের নেই, বরং এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, ওশেনিয়াসহ বহু অঞ্চলের মানুষ এখন বাস করে দেশটিতে। ফলে ভোটব্যবস্থারও ধরন অনেক পাল্টেছে। কিন্তু নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবারে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আইনটি অক্ষত রয়ে গেছে ১৭৫ বছর ধরে।
খুলনা গেজেট/এআইএন