খুলনা, বাংলাদেশ | ১৪ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ২৮শে মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অভিযান : শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদসহ গ্রেপ্তার ৪
  এটিএম আজহারের খালাসের রায়ে সই করেছেন ৭ বিচারপতি; মুক্তিতে বাধা নেই
  সীমান্তে নিরাপত্তার কোনো অভাব নেই : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ করে হত্যাচেষ্টা মামলায় সাংবাদিক শফিক রেহমানকে খালাস

নদীতে ভেসে আসা পাতা কুড়িয়ে চলে উপকূলের হিরা বেগমদের জীবন

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

আইলা’র পর থেকে গোটা এলাকা যেন বিরাণ ভূমি। একটু জ্বালানীর জন্যি তাই আমরা পানিতে ভেসে আসা পাতা কুড়াচ্ছি। বনে গিলি ফরেষ্টাররা ধরে মামলা দেয়, এই ছাড়া যে আমাগো কোনো রাস্তা নি।

কথাগুলো শেষ হতেই ‘গলুইঠেলা’ (পাতা কুড়ানোর কাজে বাঁশ ও জাল দিয়ে স্থানীয়ভাবে তৈরি বস্তু বিশেষ) হাতে নিয়ে আবারও পানিতে নেমে পড়েন হিরা বেগম।

পঞ্চাশোর্ধ্ব বয়সী চার সন্তানের জননী এ নারী পানির মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে আরও বলেন, আমাগা কোন আয় রোজগারনি। এলাকায় এটটা বড় লোকের বাড়ি নি, টাউন বন্দর নি, আমারা খাবো কি, চলবো কেমবায় (কিভাবে)। জোয়ারে ভেসে আসা কুড়ানো পাতা দে চুলতেছে (চলছে) আমাগা জীবন।

রান্নার জ্বালানী সংগ্রহ করা খুব কষ্ট উল্লেখ করে অনতিদূর থাকা রফিকুল ইসলাম জানায়, কুড়ানো পাতা মূলত তারা জ্বালানীর কাজে ব্যবহার করে। আবার অসংখ্য মানুষ নদীতে ভেসে আসা এসব পাতা কুড়িয়ে নিয়ে শুকিয়ে বিক্রি করে সংসারের খরচ যোগাচ্ছে।

শ্যামনগর উপকূলের পশ্চিম কৈখালী গ্রামের বাসিন্দা রফিকুলের দাবি এলাকায় কাজকর্ম নেই। বাধ্য হয়ে হাঙর ও কামোটের ভয়ডর উপেক্ষা করে দিনরাত নদীতে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা।

রফিকুল আরও বলেন, একার আয়ে বৃদ্ধ মা-বাপসহ সাত মুখের যোগান দিতে হয়। মাঝেমধ্যে চাল-ডালের ব্যবস্থা হলেও জ্বালানি জোটে না। তাই প্রতিদিন নদীতে জোয়ার শুরু হলে গলুইঠেলা নিয়ে নদীতে নামতে হয় আমাদের।

তবে শুধুমাত্র হিরা বেগম আর রফিকুল ইসলাম না। বরং জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা পাতা কুড়িয়ে জ্বালানীর চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সংসার চালানো এমন পরিবারের সংখ্যা রয়েছে অসংখ্য। কৈখালী থেকে শুরু করে মুন্সিগঞ্জ ও বুড়িগোয়ালীনি হয়ে গাবুরা পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল এ জনপদের হাজারও পরিবারের অন্যতম পেশায় পরিণত হয়েছে পানিতে ভেসে আসা সুন্দরবনের পাতা কুড়ানো। অনেকে আবার নদীতে ঠেলা জাল টেনে বাগদা ও গলদা রেনু ধরে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে।

পাতা কুড়ানোর কাজে জড়িতরা জানায়, পাতার সাথে সুন্দরবনের নানান প্রজাতির গাছের পাতা, ফুল ও ফল থাকে। বনের এসব ফুল ও ফল বণ্যপ্রাণী ও নদীর মাছে খায়। যে কারণে বনবিভাগের লোকজন এগুলো কুড়াতে দেয় না। ফলে বনবিভাগের চোখ ফাঁকি দিয়ে এমন কাজ করতে হয় তাদের। তবে সমগ্র এলাকা জুড়ে জ্বালানী সংকট প্রকট হওয়ায় তারা এমনটা করতে বাধ্য হচ্ছেন।

খলিশাবুনিয়া গ্রামের রাশিদুল ইসলাম বলেন, পরিবারের সদস্য সংখ্যা পাঁচজন। এলাকায় প্রায় সব জমিতে চিংড়ি ঘের থাকায় তেমন কাজকর্ম নেই। বাধ্য হয়ে স্ত্রীসহ নিজে নদীতে মাছের রেণু ধরে সংসার চালাতেন। তবে জুন মাসের শুরু থেকে নদীতে নামা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন জোয়ারে ভেসে আসা পাতা কুড়িয়ে নিয়ে গৃহস্থদের কাছে বিক্রি করছেন।

 

প্রায় অভিন্ন দাবি মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহড়তলী গ্রামের রেনুকা মন্ডলসহ আরও অনেকের।

সুন্দরবন লাগোয়া এলাকায় বসবাসরত এসব গ্রামবাসী জানায়, আইলার পর থেকে প্রায় গাছ-গাছালি শুন্য হওয়ায় এলাকায় তীব্র জ্বলানী সংকট দেখা দিয়েছে। মাঝে মধ্যে জেলেরা মাছ-কাঁকড়া ধরার সুযোগে সুন্দরবন থেকে কিছু জ্বালানী সংগ্রহ করে থাকে। ধনী পরিবারগুলো গ্যাসের চুলা ব্যবহারের পাশাপাশি শহরাঞ্চল কিংবা বরিশাল এলাকা থেকে নৌ-পথে আসা জ্বালানী ক্রয় করে প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। তবে উপকূল পাড়ে বসবাসরত হাজারও পরিবারের অন্যতম প্রধান জ্বালানী জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা সুন্দরবনের পাতা, ফুল ও ফল। তবে এসব উপকূলবাসীর ভয় পাতা সংগ্রহের কাজ বন্ধ হলে জীবন চালানো তাদের আরও কঠিন হয়ে পড়বে। ক্রয় ক্ষমতা না থাকার পাশাপাশি তীব্র জ্বালানী সংকটের মধ্যে পড়ে রীতিমত বাস্তচ্যুত হওয়ার মত পরিস্থিতির শংকায় রয়েছেন তারা। নদীতে ভেসে আসা পাতা নির্বিঘ্নে সংগ্রহে প্রশাসনিক অনুমতির দাবি তাদের।

এসব বিষয়ে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) মশিউর রহমান বলেন, সুন্দরবনের পাতা, ফুল ও ফল সাধারণত সেখানকার প্রাণী ও মাছদের খাদ্য। তাছাড়া অনেক সময় জোয়ারের পানিতে ভেসে সেগুলো বিভিন্ন চরে যেয়ে প্রাকৃতিকভাবে বনভূমির সৃষ্টি করে। কাজেই জ্বালানীর জন্য অবশ্যই উপকূলবাসীকে বিকল্প ব্যবস্থার চিন্তা করতে হবে।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!