বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেছেন, বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে নতুন বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতে ঢাকায় বিনিয়োগ সামিট সোমবার শুরু হচ্ছে। সামিটের উদ্বোধন করবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এত বেশি সাড়া পেয়েছি, অনেককে আমরা না বলতে হয়েছে। বড় নন-রেসিডেন্স বাংলাদেশি এখানে উপস্থিত হচ্ছেন।
রোববার ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট ২০২৫’ উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।
সোমবার থেকে ঢাকায় শুরু হতে যাচ্ছে এ সামিট। দেশে বৈশ্বিক বিনিয়োগের দুয়ার খুলতে ৭ থেকে ১০ এপ্রিল ৪ দিনব্যাপী এ সামিট চলবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে কথা হচ্ছে জানিয়ে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে ফেব্রুয়ারি থেকে তাদের সঙ্গে কথা বলছি। এক্ষেত্রে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে বড় ইস্যু হতে পারে জ্বালানি।
যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক বাড়ানোর বিষয়টি আমরা আগেই জানতাম,তার প্রস্তুতিও আগে থেকেই নিচ্ছি। গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে শুরু হয়েছে। আমরা তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের বলেছি, ট্রেডিং ব্যালেন্স থেকে রি–ব্যালেন্স করতে চাই। আমরা কিভাবে রিভেলেন্স করতে পারি। সেসব বিষয়ে কথা হয়েছে। তাই অস্থির হয়ে শনিবার কোনো স্টেপ নেয়নি।
ইনভেস্ট সামিটে পার্টনার প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে– ইউএনডিপি, এফসিডিও, গ্রামীণফোন, বিশ্বব্যাংক ও ফিকি। বাংলাদেশের বিনিয়োগ সম্ভাবনা তুলে ধরা, জুলাই বিপ্লব–পরবর্তী অর্থনৈতিক সংস্কার প্রদর্শন এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ আকর্ষণের লক্ষ্যে এ সামিটের আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানানো হয় সংবাদ সম্মেলনে।
বর্তমান জ্বালানি সংকটের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের কি ধরনের নিশ্চয়তা দেওয়া হবে এমন প্রশ্নের জবাবে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, জ্বালানিতে মূল সমস্যা গ্যাসের। বাংলাদেশের মোট গ্যাস সরবরাহের ৮০ শতাংশ নিজেরা সরবরাহ করি। বাকি ২০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। আমদানির ক্ষেত্রে আমরা এতদিন বড় সমস্যা মোকাবেলা করেছি ডলার সংকটকে। এ সংকটের কারণে আমরা পেমেন্ট করতে পারিনি। সেটি সুনামের ইস্যুও হয়ে পড়েছিল।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ স্থিতিশীল হয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ এখন স্থিতিশীল পর্যায়ে এসেছে। টু দ্য পয়েন্টে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলছেন তাদের এখন আইএমএফ ফান্ডিং নাও লাগতে পারে।
জ্বালানির দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি আগেই করা হয়েছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের কিছু দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি আগেই করা হয়েছিল, যেগুলোর মেয়াদ জানুয়ারি ২০২৬ এ শেষ হবে। ওই সময় থেকে আমাদের এমনিতেই চাপ কমে যাবে।
ইলন মাস্ক আসছেন না জানিয়ে চৌধুরী আশিক বলেন, ইলন মাস্ক যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের পর সরকারি কর্মকর্তা হয়ে গেছেন। আগে আনা যতটা সহজ ছিল, এখন ততটা সহজ নয়, একটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। পুরো সামিটই রান করা হবে স্টারলিংক ডিভাইস দিয়ে। স্যোসাল মিডিয়ায় যে লাইভ হবে সেটি স্টারলিংকের মাধ্যমেই হবে। গত মাসের ২৯ তারিখ আমরা এনজিএসও পলিসি চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছি। স্টারলিংক বিডার নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল, তাদের নিবন্ধন হয়ে গেছে। এনজিএসও লাইসেন্সের জন্য তারা আজকে আবেদন করবে। যতদ্রুত সম্ভব আমরা রেগুলেশন্স মেনে তারা যদি আবেদন করে থাকেন তাহলে দিয়ে দেব। নিবন্ধন পেলে পরদিনই তারা বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যেতে পারেন। আমাদের প্রতিশ্রুতি ছিল তাদেরকে ৯০ দিনের মধ্যে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেব।
সামিটে বড় বিনিয়োগকারী কারা আসবেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের পোশাক খাতের বড় কিছু ক্রেতা আসবেন। বিশেষ করে জারা বায়িং টেক্স যে কোম্পানি আছে তারা আসবে, স্যামসাংয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, বেশকিছু বড় বড় ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মের মালিকরা আসবেন। চীন থেকে সিসিসিসি, সিআরবিসি, পাওয়ারড চায়না এরকম বড় কিছু কোম্পানি আসবে।
চৌধুরী আশিক বলেন, বাংলাদেশ শ্রম আইন নিয়ে কাজ করছে। সামিটে শ্রম আইন নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে চুক্তি হবে। তাছাড়া নাসার সঙ্গে নন-মিলিটারি চুক্তি হবে সামিটে।
জানা গেছে, সামিটে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় করপোরেট ব্যক্তিদের মধ্যে— জারা গ্রুপের সিইও অস্কার গার্সিয়া মেসেইরাস, ডিপি ওয়ার্ল্ডের চেয়ারম্যান সুলতান আহমেদ বিন সুলাইয়েম, ব্রিটিশ ব্যারোনেস রোজি উইন্টারটন, স্যামসাং সি অ্যান্ড টি–র ভাইস প্রেসিডেন্ট কিয়ংসু লি, গিওর্দানোর সিইও জুনসিওক হান, এক্সেলারেট এনার্জির প্রেসিডেন্ট স্টিভেন কোবোস, এশিয়া–প্যাসিফিক অঞ্চলের উবারের পাবলিক পলিসি প্রধান মাইক অর্গিল এবং মেটার পাবলিক পলিসি ডিরেক্টর সারিম আজিজ।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধকলের মধ্যে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে উচ্চ সুদ হারের নীতিতে রয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তাছাড়া ব্যাংক ও পুঁজিবাজারের ভঙ্গুর অবস্থা বিনিয়োগকারীদের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেন, উচ্চ সুদহারের কারণে বিনিয়োগকারীরা খুব বেশি মুখ ফেরাবেন না। তাদের সামনে আমাদের নতুন বাংলাদেশের চিত্র উপস্থাপন করতে চাই। আমরা সংস্কারের মধ্যে যাচ্ছি। আমাদের অভ্যুত্থান পরবর্তী পদক্ষেপ তাদের সামনে স্পষ্ট করবো। তাছাড়া ব্যাংক খাতের অবস্থা খুব খারাপ হলেও গুটি কয়েক ব্যাংকের মুনাফা ৫ হাজার কোটি ছাড়িয়েছে।
এ সামিটের মাধ্যমে হঠাৎ করেই ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসবে এমনটি নয় উল্লেখ করে চৌধুরী আশিক বলেন, আমরা রাতারাতি ১০ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ এখানে আনবো তেমনটি নয়। আমাদের প্রথমে ন্যারেটিভ (বয়ান) ঠিক করতে হবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে যে বৈশ্বিক ন্যারেটিভ আছে সেটিকে উতরে যেতে হবে।
বাংলাদেশের বিনিয়োগ জটিলতা দূর করার জন্য বিষয়গুলো পরিষ্কার করা হবে জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে ব্যবসা করার যে কঠিন দিকগুলো বা ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সেটিকে চিহ্নিত করে দিতে হবে। আমরা অনেক ধরনের কর সুবিধা দেই- যেমন ১০ বছরের ট্যাক্স-ব্রেক আছে বেজাতে। তারপরও ১০-১২ বছরে বেজাতে কেন বিনিয়োগ আসে না। বিনিয়োগকারী তো চিন্তা করেন, তারা বিনিয়োগ করে দেশ থেকে টাকাটা বের করতে পারবেন কিনা। সেটার জন্য সময় লাগবে। সে বিনিয়োগ করে সরকারের কাছ থেকে যথেষ্ট সাপোর্ট পাবেন কিনা। এতসব প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কারভাবে আমরা তাদের দিতে পারি না। আমরা বিডায় এতদিন ফাউন্ডেশনাল জিনিসের কাজ করিনি। সামিট থেকে যে পাইপলাইন তৈরি হবে পরবর্তী ১২ বা ১৮ মাসে যাতে আমরা তাদেরকে বাংলাদেশে স্থান দেওয়ার চেষ্টা করবো।
তিনি জানান, প্রথম দিন দুটি ট্র্যাকে অনুষ্ঠানটি হবে। প্রথম ট্র্যাকে ৬০ জনের বেশি বিদেশি বিনিয়োগকারীকে নিয়ে একটি স্পেশাল ফ্লাইট চট্টগ্রাম যাবে। সেখান থেকে কোরিয়ান ইপিজেড ও মিরসরাইয়ে স্পেশাল ইকোনমিক জোন পরিদর্শন শেষে রাতে ফিরে আসবেন তারা।
বিডার নির্বাহী পরিচালক আরও জানান, যারা যাচ্ছেন তারা হলেন— সেই সব উদ্যোক্তা যারা মনে করছেন তাদের সেখানে একটি ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে হবে। তাদের জায়গা জমি লাগবে। তাদের জন্য আমরা কী ধরনের সাপোর্ট সিস্টেম তৈরি করতে পারি, তা তারা সরেজমিনে দেখবেন।
অন্যদিকে সোমবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে স্টার্টআপ কানেক্ট নামে দিনব্যাপী অনুষ্ঠানসূচি রয়েছে। সেখানে যেসব আরলি সেটজ স্টার্টআপ এবং ভেঞ্চার বিনিয়োগকারী আসছেন তাদের মধ্যে ম্যাচ মেকিং ইভেন্ট, নেটওয়ার্কিং ও প্যানেল হবে। সারাদিন স্টার্টআপ ইভেন্টকে ফোকাস করা হবে।
চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, মঙ্গলবার প্রথম বেলায় বিনিয়োগকারীদের নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে যেখানে জাপানি ইকোনমিক জোন রয়েছে সেখানে সরেজমিনে পরিদর্শন করবেন। তারা সেখানকার ফ্যাক্টরির মালিকদের সঙ্গে কথা বলে কী ধরনের কর্মকাণ্ড হচ্ছে তা বুঝে তাদের বিনিয়োগের জন্য কতটুকু সুযোগ-সুবিধা রয়েছে তা দেখবেন। দ্বিতীয় ধাপে বিশ্বব্যাংক ও আইএলও’র সঙ্গে কিছু অ্যানগেজমেন্ট আছে। তাদের এফডিআই রিলেটেড কিছু ব্যাপারে আলোচনার মাধ্যমে ভবিষ্যতে বিনিয়োগের জন্য কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যায় সে ব্যাপারে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ৯ এপ্রিল বুধবার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হবে। সকাল ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ছাড়া সারাদিনই একাধিক (তিন-চারটা) প্যারালাল অনুষ্ঠান চলবে।
খুলনা গেজেট/ টিএ