খুলনা, বাংলাদেশ | ৭ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২২ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

নতুন বছর এবং বিশ্ববাসীর কিছু পুরনো প্রত্যাশা

রুশাইদ আহমেদ

সময়ের স্বাভাবিক গতিধারায় বিশ্ব হতে বিদায় নিল ২০২৩। করোনা মহামারি ও করোনা মহামারির মধ্যেই ইউরোপের বুকে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, বছরব্যাপী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ভূমিকম্পের ঘনঘটা ও তার ফলে সৃষ্ট প্রাণহানি ও অবকাঠামোগত বিপর্যয় মোকাবিলা করার চ্যালেঞ্জ, আফ্রিকা ভূখণ্ডে সামরিক অভ্যুত্থানের হিড়িকে অবনমিত বৈশ্বিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং বছরের শেষ দিকে প্রায় তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে অব্যাহত থাকা ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত বিশ্বের মানুষের মনে নতুন বছরে কিছু পুরনো প্রত্যাশার সৃষ্টি করেছে নতুন করে।

প্রথমেই বিবেচনায় আনা যাক করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে সৃষ্ট বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পরিস্থিতির প্রসঙ্গ। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে কোভিড-১৯ বা করোনা ভাইরাসের প্রথম তাণ্ডব শুরু হলেও ২০২০ সালে ভয়াবহ সংক্রামক ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। শুরু হয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা(ডব্লিউএইচও) কর্তৃক ঘোষিত জরুরি অবস্থা। ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞরা ‘সামাজিক দূরত্ব’ তত্ত্ব বিশ্বের সামনে উপস্থাপন করেন। আর এই দূরত্ব রক্ষা করতে গিয়ে বিশ্বের মানুষ পড়ে যান কর্ম হারানোর যাঁতাকলে। কারণ সশরীরে কর্মস্থলে গিয়ে কাজ করা এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায় তখন জরুরি সেবাসমূহ বাদে। পাশাপাশি শিল্পোৎপাদন কমে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান মাত্রাতিরিক্ত লোকসান রুখতে ছাঁটাই করে দেয় অনেক কর্মী। এর সঙ্গে জ্বালানি তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের অপর্যাপ্ত সরবরাহ বিশ্বজুড়ে যে মূল্যস্ফীতির সৃষ্টি করে তার ফলে করোনাকালে বিশ্বব্যাপী সরকারি ঋণের পরিমাণ গিয়ে ঠেকে ৪০ শতাংশে। যা ছিল বিগত ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আওতাধীন সকল দেশে ঘটে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি—যা একটি মন্দার পর না ঘটাই অস্বাভাবিক।

তবে এই মন্দার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয় করোনা মহামারি সমাপ্তির প্রাক্কালে ভূরাজনৈতিক কারণে শুরু হওয়া ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। ইউক্রেন ও রাশিয়া উভয়ই বিশ্ব অর্থনীতির বিশেষত বিশ্ব জ্বালানি বাজারের এক প্রভাবশালী অংশ। পাশাপাশি শস্য রপ্তানির শীর্ষ ২০টি দেশেরও অন্তর্ভুক্ত দেশ দুটি। ফলে করোনা মহামারির মধ্যেই তাদের এ ধরনের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়া সারা বিশ্বের অর্থনীতিতে এক বিরূপ প্রভাবের সৃষ্টি করে। ইউরোপ মুখোমুখি হয় ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির। অথচ ২০২৩ সালজুড়ে বিশ্ববাসীর প্রত্যাশা ছিল করোনার ফলে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে ওঠার।

এবার ২০২৩ সালের ভূমিকম্প ইতিবৃত্তের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর পালা। ২০২৩ সালে বিশ্ব সাক্ষী হয় বেশ কয়েকটি প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের। এই বছরে বিশ্বে আঘাত হানে ১৩ হাজারের অধিক ভূমিকম্প। যার মধ্যে ১৯টিই ৭-৭.৯ মাত্রার। এসবের মধ্যে ২০২৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের গাজিয়ানতেপে ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্পে প্রাণ হারায় অর্ধ লাখেরও বেশি মানুষ। ভেঙে পড়ে দেশটির এক বৃহৎ অংশের আবাসন ব্যবস্থা। এরপর ৮ সেপ্টেম্বর মরক্কোর মারাকেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে আটলাস পর্বতমালার ইঘিল শহরের কাছে ৬.৮ মাত্রার আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানে। এতেও বহু ঘরবাড়ি ও স্থাপনা ধসে ২৯৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এর এক মাসের ব্যবধানে আফগানিস্তানের হেরাতে ৬.৩ মাত্রার জোড়া ভূমিকম্পে নিহত হন প্রায় আড়াই হাজার মানুষ। পাশাপাশি বছরজুড়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও ছোট ও মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পে কয়েকশ প্রাণহানি ও হাজার হাজার অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঘটনা ঘটে। যা নতুন বছরে বিশ্বের বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলোর মানুষের মনে পরিকল্পিত নগরায়ণের মাধ্যমে নিরাপদ ও ভূমিকম্প সহনশীল অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রত্যাশাকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে নতুন করে।

ভূমিকম্পের পরই আমাদের এগোনো উচিত আফ্রিকা ভূখণ্ডে ২০২৩ সালজুড়ে সামরিক অভ্যুত্থানের হিড়িকের প্রসঙ্গের দিকে। এই বছরে মধ্য আফ্রিকা ও সাব-সাহারান অঞ্চলের পাঁচটি দেশ: নাইজার, সিয়েরালিওন, গ্যাবন, বুরকিনা ফাসো ও গিনি বিসাওতে সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এছাড়াও এ বছরেই সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন দলের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন নিয়ে দ্বন্দ্বে সুদানে নতুন করে শুরু হয় গৃহযুদ্ধ। যাতে প্রায় অর্ধ সহস্রাধিক মানুষ নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো একই বছরে একটি মহাদেশের এতগুলো দেশে সামরিক অভ্যুত্থানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ধস নামার পরও দেশগুলোর সাধারণ মানুষেরা সামরিক অভ্যুত্থানকে সমর্থন দিয়ে উল্লাস করেছে। কারণ তারা দেশের গণতন্ত্রমনা ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থ উদ্ধারকারী নেতৃবৃন্দের চেয়ে জাতীয় স্বার্থের প্রতি যত্নশীল লোকদের প্রতি অধিক আস্থা রাখতে ইচ্ছুক।

সবশেষে ২০২৩ সালে আরেকটি যে আলোচিত প্রসঙ্গের কথা না বললেই নয়, তা হলো ঐতিহাসিক ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাত। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা হতে দেশটির স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরাইলি ভূখণ্ডে অতর্কিত হামলা চালিয়ে সহস্রাধিক ইসরাইলিকে হত্যা ও শতাধিক ইসরাইলিকে বন্দি করে নিয়ে গেলে ৯ অক্টোবর ইসরাইল গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক অবরোধ আরোপ করে অব্যাহত বিমান হামলা শুরু করে। পরে ২৭ অক্টোবর তারা গাজায় স্থল অভিযান শুরু করলে অঞ্চলটিতে দেখা দেয় ১৯৭৩ সালের পর সবচেয়ে বড় সংঘাত। এমনকি এ যুদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয় লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকের ওপর ইসরাইলের বর্বরোচিত হামলার ঘটনায় হামাস ও অন্যান্য ফিলিস্তিনি সংগঠনের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে ইসরাইলে হামলা চালালে। কিন্তু করোনা মহামারি ও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দার পর এ ধরনের যুদ্ধ কোনোভাবেই কামনা করে না বিশ্ববাসী। কেননা যে অঞ্চলটিতে এ ধরনের রক্তক্ষয়ী সংঘাত অব্যাহত আছে সেখানকার সাধারণ মানুষ ইতিপূর্বে খাদ্য, পানীয়, আশ্রয়, স্বাস্থ্যসেবাসহ অন্যান্য মৌলিক সুবিধাই ঠিকমতো পান না।

তবুও অঞ্চলটিতে অব্যাহত সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ২১ হাজারের বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে ১৫ হাজারই নারী ও শিশু। তাই অঞ্চলটিতে আরও ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় রুখতে অবিলম্বে এ যুদ্ধ বন্ধ হোক—এটাই নতুন বছরে সারা বিশ্বের প্রকৃত মানবতাবাদীদের অন্তরের পুরনো প্রত্যাশা।

খুলনা গেজেট/ এএজে




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!