খুলনা, বাংলাদেশ | ১৮ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ১লা জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  প্রাথমিক শিক্ষকদের তিন দফা দাবি আদায়ে আগামী ২৩ জুন থেকে আমরণ অনশনের ঘোষণা
  ২০০ ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদলসহ চীনা বাণিজ্যমন্ত্রী ঢাকায়, কাল সেমিনার

নড়াইলে ১০ মাসে ২৭ খুন, ঈ‌দে বাড়ি ফেরা নিয়ে সংশয়ে ৩শ’ পরিবার

নড়াইল প্রতিনিধি

নড়াইলে আধিপত্য বিস্তার,পূর্ব শত্রুতা, গ্রাম্য দলাদলি ও গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব কেড়ে নিচ্ছে একর পর এক প্রাণ। সেই সাথে ধ্বংস হচ্ছে সহায়-সম্পত্তি সব। হামলা-মামলার শিকার কয়েক’শ পরিবার নিজের ঘর ছেড়ে পরগাছার মতো অন্যত্র আশ্রয় নিচ্ছেন। ফলে এবার প্রায় ৩ শ’ পরিবারের নিজ ভিটায় ঈদে বাড়ি ফেরা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

জানা গেছে, গত ১০ মাসে লোহাগড়া ও কালিয়ায় আধিপত্য ও পূর্ব শত্রুতায় খুন হয়েছে ১৩ জন এবং আহত হয়েছে কমপক্ষে ৮০ জন। এ ছাড়া অন্যান্য কারণে আরো খুন হয়েছে ১৪ জন। হত্যাকান্ডের পর প্রতিপক্ষ ৩শ’ ৫০টির বেশি বাড়ি ও দোকান ভাংচুর-আগুন, ঘেরের মাছ, গবাদিপশু লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে। এখনো থেমে থেমে বিভিন্ন জায়গায় হামলা-ভাংচুরের ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক এসব সহিংসতায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমান কমপক্ষে ৫০ কোটি টাকা।

এদিকে কালিয়া উপজেলার বাবলা-হাচলা ইউনিয়নের কাঞ্চনপুর গ্রামের প্রভাবশালী মিলন মোল্যা ও আফতাব মোল্যা পক্ষের মধ্যে এলাকার অধিপত্য নিয়ে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এরই জেরে গত ১১ এপ্রিল দু’পক্ষের সংঘর্ষে আফতাব গ্রুপের ফরিদ মোল্যা খুন ও ১৫ জন আহত হয়। ১৮ দিন পর ২৯ এপ্রিল ফরিদ হত্যা মামলার ১৮ নম্বর আসামি রফিকুল মোল্যার মরদেহ এক প্রতিপক্ষের বাড়ির পিছন থেকে উদ্ধার করা হয়। দু’পক্ষের এ পাল্টাপাল্টি দ্বন্দ্ব-সংঘাতে এ পর্যন্ত প্রায় ২৫ টি পরিবারের প্রায় ৫০ টি বাড়ি ভাংচুর-আগুনের পাশাপাশি মালামাল, ফসল, গবাদিপশু ও ঘেরের মাছ লুটপাটের ঘটনা ঘটে।

কাঞ্চনপুর গ্রামের বৃদ্ধা রাশেদা বেগমের অভিযোগ, মিলন মোল্যার পক্ষের লোকজন তার বাড়ি দু’দফা ভাংচুর-লুটপাটের কারণে বাড়িতে রান্নার চাল, থালা-বাটি কিছু নেই। টিউবওয়েল পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। কোরবানী ঈদের কথা নাই বা বললাম, পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় যাব কি খাব-তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তায় আছি।

একই গ্রামের কামরুল কাজীর স্ত্রী জোসনা বেগম জানান, প্রতিপক্ষ আফতাব মোল্যার লোকজন এলাকায় মাইকিং করে আমাদেরসহ মিলন মোল্যার পক্ষের কমপক্ষে ৫০ বিঘা জমির বোরো ধান কেটে নিয়ে গেছে। দু’দফা বাড়ি ভাংচুর-লুটপাট করায় অন্য গ্রামে মানবেতর জীবনযাপন করছি। বাড়ি ভাংচুর ও আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এখন ঈদ কোথায় করবো জানিনা।

ঈদুল ফিতরের আগের দিন ৩০ মার্চ পেড়লী ইউনিয়নের জামরিলডাঙ্গা গ্রামের লস্কর ও শেখ বংশের দ্বন্দ্বে দু’পক্ষের সংঘর্ষে তালেব শেখ খুন ও ১৫ জন আহত হন। ১৫ মার্চ হামিদপুর ইউনিয়নের সিলিমপুর গ্রামের হামিম মোল্যার সাথে জনি মোল্যা গ্রুপের এলাকার আধিপত্যকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপের সংঘর্ষে বিএনপি কর্মী জনি মোল্যা গ্রুপের হাসিম মোল্যা খুন ও ৮ জন আহত হয়। ১২ মার্চ জয়নগর ইউনিয়নের চরশুকতাইল গ্রামের আনসার জমাদ্দার ও হেকমত শেখের লোকজনের মধ্যে গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে সৌদি প্রবাসী আকরাম শেখ খুন হয়। পুরুলিয়া ইউনিয়নের চাঁদপুর গ্রামের অমিয়ার মোল্যা গ্রুপের সাথে শিরাফুল শেখ গ্রুপের এলাকার আধিপত্যে শিরাফুল গ্রুপের সুলতান মোল্যা খুন হয়। এ ঘটনায় আহত হয় ১০ জন।

অন্যদিকে লোহাগড়ায় ১৪ মে ইতনা ইউনিয়নের কুমারডাঙ্গা গ্রামের এসকেন্দার শেখের সাথে খাজা মোল্যার পূর্ব বিরোধের জেরে খাজা মোল্যা খুন হয়। এ মামলার আসামি ইনসান শেখের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেবার পর তার স্ত্রী বৃদ্ধ মেহেরুন্নেসা বর্তমানে গোয়াল ঘরে বসবাস করছেন।

তিনি কান্নাজড়িত কন্ঠে জানান, বাদী পক্ষের লোকজন আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার পর সর্বস্ব হারিয়েছি। ১২টি মাছের ঘের, ২৫ভরি স্বর্ণালংকার, নগদ টাকা ও কোরবানির গরুসহ ৪টি গরু লুট করে নিয়ে গেছে। এখন ঈদ কিভাবে করবো আল্লাহ জানেন।

৮ মে মল্লিকপুর ইউনিয়নের করফা গ্রামের কৃষক টোকন আলী পারিবারিক বিরোধের জেরে খুন এবং এ ঘটনায় আহত হয় ৪ জন। ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতরের দিন লাহুড়িয়া ইউনিয়নের লাহুড়িয়া গ্রামের মনিরুল জমাদ্দার ও একই গ্রামের মিল্টন জমাদ্দার গ্রুপের মধ্যে পূর্ব শত্রুতার জেরে দু’পক্ষের সংষর্ষে লাহুড়িয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা আকবার শেখ নিহত ও আহত হয় ১৫ জন। ২০২৪ সালের ১১ সেপ্টম্বর মল্লিকপুর ইউনিয়নের চর মল্লিকপুর গ্রামে লোহাগড়া উপজেলা যুবদলের সভাপতি মাহমুদ খান ও জেলা বিএনপির সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস শেখের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারের জেরে দু’পক্ষের সংঘর্ষে ইউনিয়ন বিএনপি কর্মী মিরান শেখ ও তার আপন ভাই জিয়া শেখ খুন ও আহত হয় ৭ জন। ১ আগস্ট লক্ষীপাশা ইউনিয়নের বয়রা গ্রামে পারভেজ কাজীর সাথে ইমদাদ কাজীর বিরোধের জেরে নয়ন শেখ খুন ও আহত হয় ১জন। ৯ মে উপজেলার নোয়াগ্রাম ইউনিয়নের শামুকখোলা গ্রামের খাজা খন্দকারের ছেলে যুবদল কর্মী সালমান খন্দকার স্থানীয় দ্বন্দ্বে খুন হয়।

এ ছাড়া জেলায় বিভিন্ন কারণে আরো ১৪ জন খুনের শিকার হন। ৩০ মার্চ লোহাগড়ার লক্ষীপাশা বাজারে সবজি ক্রয়ের সময় কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে নড়াইল জেলা বাস-মিনিবাস ও মাইক্রেবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ-আল-মামুনকে কাঁচামাল ব্যবসায়ী পিটিয়ে হত্যা করে। ১২ মার্চ নোয়গ্রাম ইউনিয়নের চর-শামুকখোলা গ্রামে ৪ বছরের শাহাদাতের মরদেহ উদ্ধার হয়। এ ঘটনায় পুলিশ নিহতের সৎ দাদীকে গ্রেপ্তার করে। ২৪ ডিসেম্বর সদরের মাইজপাড়া ইউপি মেম্বর বাসনা মল্লিক পরিষদের কাজ শেষে সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে স্থানীয় দৌলতপুর গ্রামের রাজিবুল ইসলামসহ সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়। অভিযোগ, ধর্ষণ শেষে তার মুখে বিষ ঢেলে দেয়। এর ৩দিন পর বাসনা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। ১ ডিসেম্বর লোহাগড়ার মঙ্গলপুর গ্রামের বাক প্রতিবন্ধি ভ্যান চালক শওকত লস্করকে দৃবৃত্তরা স্বাসরোধে হত্যা করে ইজি ভ্যান নিয়ে যায়। পাশ্ববর্তী ছালামাবাদ ইউনিয়নের বলাডাঙ্গা গ্রামে তার মরদেহ পাওয়া যায়। ১৪ নভেম্বর পারিবারিক বিরোধে খাসিয়াল ইউনিয়নের পাকুরিয়া গ্রামের ৬ বছরের হামিদার বাড়ির পাশ থেকে দু’হাতবাঁধা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৯ অক্টোবর গরু চোর সন্দেহে নড়াইলের তুলারামপুর-বেতেঙ্গা গ্রাম থেকে সদরের মাইজপাড়া গ্রামের দুলাল, লোহাগড়ার তেলকাড়া গ্রামের জান্নাতুল শেখ ও বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ থানার আউলাদিপুর গ্রামের নুরুন্নবী মোল্যাকে বিক্ষুব্ধ জনতা হত্যা করে। ২১ অক্টোবর ইতনা ইউনিয়নের চর-দৌলতপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবিতা রাণী বালা দুবৃত্তদের হাতে নিজ বাড়িতে খুন হন। ১৬ সেপ্টেম্বর সদরের বিছালী ইউনিয়নের মির্জাপুর গ্রামে ৪ বছরের রাশেদুলকে তার সৎ মা রহিমা বেগম স্বাসরোধে হত্যা করে। ৯ সেপ্টেম্বর সদরের শেখাটি ইউনিয়নের কাইজদাহ গ্রামের শিমুল গাজীকে ঘরের মধ্যে হত্যা করে মাটি চাপা দেয় তারই স্ত্রী পলি বেগম। ৮ সেপ্টম্বর পুরুলিয়া ইউনিয়নের রঘুনাথপুর গ্রামের কলেজ ছাত্র নাছিম শেখকে একই গ্রামের পাঞ্জা শেখের বাড়ির পাশ থেকে দুবৃত্তরা হত্যা করে। ৯ আগস্ট সদরের সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের বড়গাতি গ্রামের হাকিম মোল্যার রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করে স্থানীয় চুনখোলা এলাকার চিত্রা নদী থেকে। ৫ আগস্ট সন্ধ্যার দিকে নড়াইল জেলা কারাগারের পাশ থেকে শহরের বরাশোলা এলাকার নিষিদ্ধ যুবলীগ কর্মী মাজেদ খান দুবৃত্তের হাতে খুন হয়।

নড়াইলের আইনশৃংখলা পরিস্থিতি সম্পর্কে নড়াইলের পুলিশ সুপার কাজী এহসানুল কবীর বলেন,‘নড়াইলে সাধারণত প্রত্যন্ত অঞলে গোষ্ঠীগত ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্ত্র করে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। একটা ঘটনা ঘটলে প্রতি ঘটনা হিসেবে মানুষজন বাড়িঘর ভাংচুর বা অগ্নিসংযোগের ঘটছে। এসব ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আমরা চেষ্টা করছি। সবাইকে সচেতন করার চেষ্টা করছি, যোগাযোগ করছি, কাউন্সিলিং করছি। প্রয়োজনের তুলনায় পুলিশের সংখ্যা নগন্য। তারপরেও আমরা চেষ্টা করছি। এসব ঘটনার বিস্তার যাতে না বাড়ে সে চেষ্টা। মানুষ যাতে পুলিশ এলাকার আইনশৃংখলা স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। যাতে নড়াইলের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে।’

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!