খুলনা, বাংলাদেশ | ১১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  কুমিল্লায় অটোরিকশায় ট্রেনের ধাক্কায় নিহত বেড়ে ৭
  মানবতাবিরোধী অপরাধ : চিফ প্রসিকিউটর দেশে না থাকায় ফখরুজ্জামান ও সাত্তারের জামিন শুনানি ২ সপ্তাহ পেছাল আপিল বিভাগ
মেয়র হিসেবে তিন মেয়াদ

নগর ভবনে খালেকের দুর্নীতি ও লুটপাটের কালো অধ্যায়

এ এইচ হিমালয়

সভা-সমাবেশে বক্তৃতায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঝড় তুলতেন তিনি। সড়কে উন্নয়নকাজ পরিদর্শনে গিয়ে বিটুমিন খুঁড়তেন, ইট ভেঙে যাচাই করতেন মান। এসব ভিডিও ছড়িয়ে সামাজিক মাধ্যমে তাঁর সততার বন্দনা করতেন অনুসারীরা। খুলনার সাধারণ মানুষের ভাবনাও ছিল এমন। কিন্তু প্রকৃত চিত্র ভিন্ন। এমন মুখোশের আড়ালে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের কালো অধ্যায় গড়েছেন খুলনা সিটি করপোরেশনের অপসারিত মেয়র তালুকদার আবদুল খালেক। একদিকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা, অন্যদিকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মহানগর সভাপতি হওয়ায় তাঁর নিয়ন্ত্রণেই ছিল খুলনার সবকিছু। এই ক্ষমতা কাজে লাগিয়েই তিনি খুলে বসেন অনিয়ম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দরবার।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আইন লঙ্ঘন করে অন্যের লাইসেন্সে নিজেই ঠিকাদারি করতেন তালুকদার আবদুল খালেক। মেসার্স হোসেন ট্রেডার্স, আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্স ও মেসার্স তাজুল ইসলাম নামের তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের নামে গত কয়েক বছরে প্রায় ৬০ কোটি টাকার কাজ করেছেন তিনি। ঠিকাদার এইচ এম সেলিম (সেলিম হুজুর) এসব কাজ দেখাশোনা করতেন। এর বাইরে ৫ শতাংশ কমিশনের ভিত্তিতে আরও প্রায় শতকোটি টাকার উন্নয়নকাজ বড় ঠিকাদারের কাছে বিক্রি করেছেন। আবার লাইসেন্স ছাড়াই পছন্দের ব্যক্তি, আওয়ামী লীগের নেতা ও কাউন্সিলরদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছেন কোটি কোটি টাকার কাজ। ওই কাজই বিপুল অঙ্কের টাকা দিয়ে কিনে নিতে হতো সাধারণ ঠিকাদারদের।

এ ছাড়া মন্ত্রণালয়ের খরচের কথা বলে চার বছর দুই মাস ধরে কাজের বিলের ১ শতাংশ করে কেটে নেওয়া হয়েছে ঠিকাদারদের কাছ থেকে। বিপুল অঙ্কের সেই টাকা কোথায় খরচ হয়েছে, কেউ জানে না। এক পর্যায়ে বিষয়টি আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের জানালে সেই টাকা নেওয়া বন্ধ করা হয়।

সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিতর্কিত ব্যবসায়ী আমজাদ হোসেনের লুটপাটের পেছনেও বড় ভূমিকা ছিল তালুকদার আবদুল খালেকের। অভিযোগ রয়েছে, খালেকের পৃষ্ঠপোষকতায় বেপরোয়া হয়ে ওঠেন আমজাদ। বিনিময়ে ব্যাংকের কয়েক কোটি টাকার শেয়ার লিখে দেওয়া হয় খালেকের নামে। তাঁকে বানানো হয় ব্যাংকটির ভাইস চেয়ারম্যান। পরে ব্যাংকে লুটপাট নিয়ে বিতর্ক তৈরি হলে খালেক পদত্যাগ করেন।

আমজাদ হোসেনের মালিকানাধীন মুনস্টার পলিমার এক্সপোর্ট লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন তালুকদার খালেক। শুল্ক ফাঁকির অভিযোগে কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল ও পাঁচ কোটি টাকা অর্থদণ্ড দেওয়া হলে সেখান থেকেও পদত্যাগ করেন খালেক। এ নিয়ে লেখালেখি করায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির খুলনা প্রতিনিধি আবু তৈয়বের বিরুদ্ধে।

আওয়ামী লীগের তৃতীয় মেয়াদে তালুকদার খালেকের দুর্ব্যবহারে অতিষ্ঠ ছিলেন নগর ভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও প্রকৌশলীরা। তুচ্ছ কারণে অকথ্য ভাষায় গালাগাল থেকে নিস্তার পাননি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও। বিষয়টি নিয়ে সবার মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল।

বেনামে শতকোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ

স্থানীয় সরকার আইন, ২০০৯ (সিটি করপোরেশন)-এর ধারা ৯(২) অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি মেয়র বা কাউন্সিলর পদে নির্বাচিত হওয়ার অথবা মেয়র বা কাউন্সিলর পদে থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি বা তাঁর পরিবারের কোনো সদস্য সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশনের কাজ সম্পাদন বা মালপত্র সরবরাহের জন্য ঠিকাদার হন। অথবা তারা এ ধরনের কাজে নিযুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অংশীদার হন বা সিটি করপোরেশনের কোনো বিষয়ে তাদের কোনো ধরনের আর্থিক স্বার্থ থাকে। কিন্তু আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে বীরদর্পে ঠিকাদারি করেছেন তালুকদার খালেক।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ঠিকাদারি ছিল তালুকদার খালেকের মূল পেশা। ২০০৮ সালে কেসিসির মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১২ সালে প্রথমবার বয়রা কলেজের সামনে সড়ক উন্নয়নের কাজ করেন তিনি। সেই কাজ দেখাশোনা করতেন ভাই জলিল তালুকদার।

২০১৮ সালে দ্বিতীয়বার মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন খালেক। উন্মুক্ত পদ্ধতিতে দরপত্র (ওটিএম) আহ্বান হলে কেসিসির প্রকৌশলীদের নির্দেশ দিতেন, নির্দিষ্ট কাজে অন্য বড় ঠিকাদাররা কেউ যাতে দরপত্র জমা না দেয়। আর দিলেও ইজিপির ফাঁকফোকর দিয়ে কাজটি তিনি দিয়ে দিতেন হোসেন ট্রেডার্সকে। হোসেন ট্রেডার্সের নামে মেয়রের ঠিকাদারির বিষয়টি কেসিসিতে ‘ওপেন সিক্রেট’।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, হোসেন ট্রেডার্সের নামে তালুকদার আবদুল খালেক ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে বিআইডিসি সড়কের একাংশ, ৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা ব্যয়ে রূপসা বেড়িবাঁধ সড়ক উন্নয়ন, ৩ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে কে ডি ঘোষ রোড, ৩ কোটি ৩৭ লাখ টাকা ব্যয়ে পুরাতন যশোর রোড, ৩ কোটি ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সিমেট্রি রোড, ৪ কোটি ৫২ লাখ টাকা ব্যয়ে নিরালা আবাসিক এলাকার পাঁচটি সড়ক উন্নয়নসহ ১৭টি সড়কের ঠিকাদারি করেছেন।

এ ছাড়া আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের নামে ২ কোটি ৫১ লাখ টাকায় মুন্সিপাড়া তৃতীয় গলি, ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে গগন বাবু রোড উন্নয়ন, তাজুল ইসলামের নামে খালিশপুর পিপলস মোড় থেকে গাছতলা মোড় পর্যন্তসহ আরও চারটি কাজ করেছেন।

উন্নয়নকাজ ইচ্ছামতো বাটোয়ারা

দরপত্রে অংশ নিতে ঠিকাদারি লাইসেন্স প্রয়োজন হয়। কিন্তু লাইসেন্স ছাড়াই অন্য নামে আওয়ামী লীগ নেতাদের ঠিকাদারি কাজ দিতেন তালুকদার আবদুল খালেক। এ পদ্ধতিতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম ডি এ বাবুল রানাকে নিরালার আটটি সড়কের ৩ কোটি ৭৪ লাখ টাকার, ৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে টিবি ক্রস রোড এবং বানরগাতী সড়কের কাজ দেওয়া হয়েছে। মেসার্স তাজুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের নামে কাজ করেছেন তিনি।

বাবুল রানা বর্তমানে আত্মগোপনে। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে ঠিকাদার তাজুল ইসলাম সমকালকে বলেন, দলের সিনিয়র নেতা হওয়ায় আমি লাইসেন্স দিয়ে সহযোগিতা করেছি। কাজটি তিনি নিজেই করেছেন।

একইভাবে ৫ কোটি ১ লাখ টাকা ব্যয়ে খালিশপুর ১৮ নম্বর রোড উন্নয়নের কাজ দেওয়া হয়েছে খালিশপুর থানার ৯টি ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে। শাহীদ এন্টারপ্রাইজের নামে দেওয়া কাজটি ২৫ লাখ টাকায় কিনে নেন তাজুল ইসলাম। ওই টাকা ৯ ওয়ার্ডের নেতারা ভাগ করে নেন।

এ বিষয়ে তাজুল ইসলাম বলেন, ওই সময় কিছু করার ছিল না। টাকা দিয়ে কিনেই কাজ করতে হয়েছে। একইভাবে বিভিন্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর, আওয়ামী লীগ নেতা ও ১৪ দলের কয়েকজন নেতাকে কাজ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।

নগর ভবন থেকেই নিয়ন্ত্রণ করতেন রামপাল ও মোংলা

বাগেরহাট-৩ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন তালুকদার আবদুল খালেক। কেসিসি মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আসনটিতে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তাঁর স্ত্রী হাবিবুন নাহার। কিন্তু খালেকই রামপাল ও মোংলা উপজেলার সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। সভা-সমাবেশে অংশ নিতে রামপালে গেলে ব্যবহার করতেন কেসিসির গাড়ি ও তেল।
নগর ভবনে বসেই ওই দুই উপজেলার সব ঠিকাদারি কাজ ভাগবাটোয়ারা, টিআর বরাদ্দ, উন্নয়নকাজ কীভাবে হবে– নির্দেশ দিতেন। প্রায়ই কর্মকর্তাদের ডেকে আনতেন নগর ভবনে।

১৫ বছরে বিপুল সম্পদের মালিক

২০০৮ সালের তথ্য অনুযায়ী, তালুকদার আবদুল খালেকের বার্ষিক আয় ছিল ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। তাঁর কাছে নগদ টাকা ছিল ৫৭ হাজার ৫৫০। সম্পদ বলতে ছিল ব্যাংকে জমা ১৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকা, সঞ্চয়পত্র ও স্থায়ী আমানতে ২৮ লাখ টাকা। কিন্তু গত ১৫ বছরে বহু গুণে ফুলেফেঁপে উঠেছে খালেকের সম্পদ।
২০২৩ সালের হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, খালেকের আয় ২৮ লাখ ১৫ হাজার ৭০২ টাকা। তাঁর কাছে নগদ টাকা আছে ৪ কোটি ৭৯ লাখ। চারটি ব্যাংকে তাঁর জমা ১ কোটি ১৮ হাজার টাকা। এর বাইরে ৩.২১ একর কৃষিজমি, ৩ কাঠা অকৃষিজমি, রাজউকের পূর্বাচলে একটি, কেডিএর ময়ূরী আবাসিকে একটি, গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের মুজগুন্নি আবাসিকে প্লট রয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য

গত ৫ আগস্টের পর থেকে তালুকদার আবদুল খালেক আত্মগোপনে রয়েছেন। তিনি কোথায় রয়েছেন, তা কেউই বলতে পারছেন না। তাঁর মোবাইল ফোনও বন্ধ।

মেয়রের ঠিকাদারি কাজ দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা এইচ এম সেলিম সমকালকে বলেন, ‘মেয়র সাহেবের সঙ্গে শুধু ডাকবাংলো ও কাস্টমঘাট সড়কের কাজ করেছি। আমার লাইসেন্সে বিভিন্নজন কাজ করেছে। সব কাজ মেয়র সাহেবের বলে চালানো হচ্ছে। এটা ঠিক না।’

আজাদ ইঞ্জিনিয়ার্সের তৌহিদুল ইসলাম আজাদ দাবি করেন, আমাদের লাইসেন্সে অনেকেই কাজ করছেন। তবে মেয়র কোনো কাজ করেননি।

৫ শতাংশ টাকা দিয়ে কাজ কেনা দু’জন ঠিকাদার অর্থ লেনদেনের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। কিন্তু তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

কেসিসির প্রধান প্রকৌশলী মশিউজ্জামান খান বলেন, কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।

কেসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা লস্কর তাজুল ইসলাম বলেন, দরপত্র প্রক্রিয়ায় আমার সংশ্লিষ্টতা নেই। অনেক কিছুই জানি না। তারপরও কোনো অনিয়ম হলে খুঁজে বের করে বিচারের ব্যবস্থা হবে।

সূত্র : সমকাল

 




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!