খুলনা, বাংলাদেশ | ১০ পৌষ, ১৪৩১ | ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  চাঁদপুরে জাহাজে ৭ জনকে হত্যা: আসামি ইরফান ৭ দিনের রিমান্ডে

দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য শেখ আব্দুল কাইয়ুমের অবদান স্মরণীয়

কাজী মোতাহার রহমান

চার যুগেরও বেশি সময় ধরে জাতীয়তাবাদী ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ ছিলেন খুলনার শেখ আব্দুল কাইয়ুম। লড়াই করেছেন জে. আইয়ুব, জে. ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। স্বাধীনতা উত্তরকালেও লড়াই করেছেন মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সমুন্নত রাখতে সব সময় ছিলেন স্বোচ্চার। রুটি-রুজির আন্দোলন ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্র সৈনিক। তার রাজনৈতিক জীবনের বড় অর্জন শহীদ হাদিস পার্কে স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলন, ৭১’র ২৩ মার্চ তারিখে। যা খুলনার মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে।

১৯৬৬ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তিনি রাজনীতিতে পদার্পণ করেন। পাশাপাাশি ৬৯ সালে ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেন। রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান (আগরতলা) এর ঐতিহাসিক মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে ছাত্র সমাজকে সংগঠিত করেছেন। খুলনার রাজপথে চিৎকার করে স্লোগান দিয়েছেন ‘জেলের তালা ভাঙবো, শেখ মুজিবকে আনবো’।

একই দাবিতে খুলনার রাজপথে মিছিল হয়েছে একাধিকবার। হরতাল হয়েছে ছাত্রলীগ ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে। ৬৯’র অগ্নিঝরা দিনগুলোতে তিনি খুলনা জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। সামরিক আইন লংঘন করায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। জারি করা হয় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। তবুও তিনি রাজপথে ছিলেন। ১৯৭১ সালে কেন্দ্রের নির্দেশে খুলনায় গঠিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তিনি ছিলেন অন্যতম সদস্য। ৭১’র মার্চে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াস অংশের পরামর্শে জিলা স্কুল মাঠে যুবকদের যুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। জিলা স্কুলে ক্যাডেটদের ড্যামী রাইফেল দিয়ে তিনি প্রশিক্ষণ দিতেন।

যুদ্ধের প্রস্তুতিলগ্নে তিনি ছিলেন জয় বাংলা বাহিনী, খুলনার প্রধান। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশনার আলোকে খুলনার পিকচার প্যালেস, নগর ভবন ও স্টেট ব্যাংক (বাংলাদেশ ব্যাংক) এর দেয়ালে স্লোগান লিখেছেন ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’। স্লোগানের ভাষা ছিল ‘তোমার আমার ঠিাকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’। ৭০’র নির্বাচনের পরপর খুলনা সার্কিট হাউজে পাকসেনা ছাউনী গড়ে ওঠে। এখানকার সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল শামস-উল-জামান। তার নির্দেশে কনভয় খুলনার রাজপথে টহল দিতো। কনভয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ব্যাঘ্রমুর্তি।

খুলনার মানুষ স্বাধীনতার দাবিতে ১ মার্চ থেকে রাজপথে মিছিল করছে। লবণচরা কোরাইশী স্টিল মিল, শিপইয়ার্ড, পিএমসি (আজকের বিএমসি), দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরী, খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল্স, হার্ডবোর্ড মিল্স, গোয়ালপাড়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল ও দৌলতপুরের জুট মিলের শ্রমিকরা উৎপাদন বন্ধ করে রাস্তায় নামে। এক শ^াসরুদ্ধকর পরিস্থিতি। সেই মুহূর্তে ২ মার্চ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে স্বাধীনতার পতাকা প্রথম উত্তোলিত হয়। স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টি হতে থাকে। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশনা অনুযায়ী স্বাধীনতার পতাকার নকশা খুলনায় নিয়ে আসেন সে সময়কার ছাত্রনেতা যশোরের রবিউল আলম ও সাংবাদিক বদিউজ্জামান। খুলনার তুলা পট্টিতে পতাকা তৈরি হয়। তখনকার দিনে মধ্যবিত্ত পরিবারে সচরাচর টেলিফোন সংযোগ ছিল না। মার্চের প্রথমদিকে স্বাধীনবাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও ডাকসু’র ভিপি আ স ম আব্দুর রব খুলনার পিকচার প্যালেস সিনেমা হলে টেলিফোন করে বিএল কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি স ম বাবর আলী ও শেখ আব্দুল কাইয়ুমকে খুলনার মাটিতে ২৩ মার্চ পতাকা উত্তোলনের নির্দেশনা দেন। এ নির্দেশনা পাওয়ার পর বিশেষ করে ছাত্রলীগের মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করে। নেতৃস্থানীয়রা প্রহর গুনতে থাকে ২৩ মার্চ শুভক্ষণের দিনটির জন্যে। খুলনার পথে পথে পাকবাহিনী টহল দিচ্ছে। সোসাইটি সিনেমা হলের সামনে পাকবাহিনীর কনভয় অবস্থান নিয়েছে। ২৩ মার্চ সকালে শহরের বিভিন্ন মহল্লা থেকে ছাত্ররা দলে-দলে এসে হাদিস পার্কে সমবেত হয়। জাতীয় সংগীত বাজনোর তালে-তালে হাদিস পার্কে লাল-সবুজের পতাকা উত্তোলন করেন স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের খুলনা জেলার সদস্য, জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান শেখ আব্দুল কাইয়ুম।

২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর হাদিস পার্কে শেখ কাইয়ুমের জানাজা অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বৃহত্তর খুলনা মুজিববাহিনীর প্রধান শেখ কামরুজ্জামান টুকু স্থানটি চিহ্নিত করে বলেন, এখানেই খুলনার ছাত্র সামজের প্রিয় নেতা আমার ¯েœহধন্য কাইয়ুম পতাকা উত্তোলন করে। প্রয়াত শেখ কাইয়ুমের ৫০ বছর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন পাকসৈন্য পরিবেষ্টিত খুলনার মাটিতে স্বাধীনতার লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো। তিনি ৪৫ বছর এ গর্ব বুকে ধারণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রতিষ্ঠার জন্য নানা ফোরামে দাঁড়িয়ে আন্দোলন করেছেন। ঘাতক দালাল নির্মুল জাতীয় সমন্বয় কমিটিতেও তার ভূমিকা ছিল অনন্য। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তিনি ছিলেন সবসময় স্বোচ্চার।

তার রাজনৈতিক জীবনের আরও উল্লেখযোগ্য প্রেক্ষাপট তিনি জীবনকে বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন ভারতের হাফলং-এ। যুদ্ধ করেছেন সাতক্ষীরা মহাকুমার তালা, কপিলমুনি ও স্বাধীনতার ঊষালগ্নে গল্লামারীতে। ৭১’র ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে কপিলমুনি বিজয়ের পর একশ’ ৫১ যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দু’জনের মধ্যে তিনি একজন। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রাখতে হাদিস পার্কে ভাস্কর্য দুর্জয়-৭১ স্থাপনের অন্যতম সংগঠক। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপট মূল্যায়ন করতে যেয়ে চারটি বিষয় প্রাধান্য পায়। প্রথমটি তিনি জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান, ২৩ মার্চের পতাকা উত্তোলন, কপিলমুনি যুদ্ধের যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার দু’জনের একজন এবং হাদিস পার্কে ভাস্কর্য দুর্জয়-৭১ এর সংগঠক। এ গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা চার বছর আগে দূরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পরপারে পাড়ি জমিয়েছেন। দেশ ও জাতির মুক্তির জন্য তিনি যে অবদান রেখেছেন সেজন্য তার প্রতি সশ্রদ্ধ সালাম। আজকের দিনে আমাদের প্রত্যাশা তার স্মৃতি অমর হোক।

 

খুলনা গেজেট/এএ




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!