শিশু শ্রম এখন বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি বড় আকারের সমস্যা। শিশুদের মেধা বিকাশের আগেই তাদেরকে শ্রমে বিনিয়োগ করায় আমাদের নতুন প্রজন্ম যথাযথভাবে বিকশিত হতে পারছে না। এজন্য শিশু শ্রম নিরসনে দেশের প্রচলিত আইনের বাস্তবায়ন জরুরী। একই সাথে সরকারি ও বেসরকারি যৌথ উদ্যোগে সামাজিক সচেতনতামূলক প্রচার অভিযান জোরদার করতে হবে। কারণ শিশুদের পারিবারিক দারিদ্রের সুযোগে তাদেরকে শ্রম কাজে নিয়োগ করা হলে তারা তাদের বুদ্ধি ও মেধার বিকাশ থেকে বঞ্চিত হয়।
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে বুধবার (২২ ডিসেম্বর) বিকালে অনুষ্ঠিত শিশু শ্রম সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালার যথাযথ বাস্তবায়ন ও করনীয় শীর্ষক এক আলোচনা সভায় উদ্যোক্তারা এসব কথা বলেন। এডুকো এর সহযোগিতায় বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বিপদসংকুল শিশু শ্রম প্রতিরোধ ও বর্জন প্রকল্পের আওতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উত্তরণ’ এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘উত্তরণ’ এর পরিচালক শহীদুল ইসলামের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন, সাতক্ষীরা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কাজী আরিফুর রহমান ও বিশেষ অতিথি ছিলেন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ রুহুল আমিন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন, সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি সুভাষ চৌধুরী, সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম, সাবেক সভাপতি মোঃ মিজানুর রহমান, বেসরকারি সংস্থা স্বদেশ পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত, সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কোহিনূর ইসলাম, মহিলা পরিষদের সাধারন সম্পাদক জোৎ¯œা দত্ত প্রমুখ।
প্রধান অতিথি বলেন, সরকার শিশুশ্রম নিরসনে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণের পাশাপাশি বিদ্যমান আইনের প্রয়োগ করে যাচ্ছে। তা সত্তে¡ও পারিপাশির্^ক নানা কারণে শিশুশ্রম রোধ করা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সাতক্ষীরার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক আরও বলেন, এখানে বারবার দুর্যোগ হানা দেয়। এ কারণে কয়েকটি উপজেলার শতশত পরিবার বারবার অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। শিশুরাও এই ক্ষতির শিকার হয়ে বাবা মায়ের দারিদ্রের কারণে তারা ছোট বয়সেই শ্রম বিনিয়োগ শুরু করে। বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম বিনিয়োগের ফলে আমাদের শিশুদের কাছ থেকে আমরা কাঙ্খিত মেধার বহিঃপ্রকাশ পাচ্ছি না। তিনি বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরনের জন্য সরকারের পাশাপাশি ‘উত্তরণ’ এর মতো বেসরকারি সংস্থাসহ সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। এজন্য জেলা পর্যায়ে একটি ক্লাস্টার গঠনেরও প্রস্তাাবের প্রতি সম্মতি জ্ঞাপন করেন তিনি।
বিশেষ অতিথি সাতক্ষীরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ রুহুল আমিন বলেন, এই জেলায় ১ হাজার ৯৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুরা অধ্যয়ন করে। এসব শিশুদের সব তথ্য তার অফিস সংরক্ষণ করে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার তাদের বিনামূল্যে বই, খাতাপত্র, খাদ্য ও আর্থিক সেবাও দিয়ে আসছে। তা সত্তে¡ও করোনাকালে এবং দুর্যোগকালে তাদের পরিবারগুলো তাদেরকে শ্রম বিনিয়োগে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই প্রবনতাকে রোধ করতে হলে প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলির সমন্বয় সাধন।
আলোচনা সভার সভাপতি ‘উত্তরণ’ পরিচালক শহীদুল ইসলাম বলেন, তারা শিশুশ্রম নিরসনে সরকারের পাশাপাশি কাজ করে যাচ্ছেন। এজন্য শ্যামনগরে একটি পরিবেক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। সামাজিকভাবে আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই উল্লেখ কওে তিনি আরো বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়া হাজার হাজার পরিবার এখন শহরমুখী হয়েছে। তাদেরকেও যথাযথভাবে চিহ্নিত করে সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এর ফলে তারাও ঝুঁকিপূর্ণ নানা পেশায় নিজেদের নিয়োগ করছেন। সরকারি হিসাবে আমাদের সূচক ৭.২ এরও বেশি এবং সেটি আশাব্যঞ্জক উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ১৭ লাখ শিশুশ্রম পরিবারকে একটি সেফটি নেটওয়ার্কের মধ্যে আনা গেলে কাঙ্খিত ফল লাভ করা সম্ভব হবে। আলোচনা সভায় বলা হয় ২০১৩ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ৫ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা সাড়ে ৩৪ লাখের মধ্যে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১৭ লাক। জরিপ অনুুুযায়ী ঝুঁকিপর্ণ শ্রম কাজে নিয়োজিত শিশুর সংখ্যা ১২ লাখ আশি হাজার। এর মধ্যে ছেলে শিশু শ্রমিক সাড়ে নয় লাখ এবং মেয়ে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে সাত লাখ। গ্রাম এলাকায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সাড়ে ১১ লাখ এবং শহর এলাকায় তা দুই লাখ নব্বই হাজার। এছাড়া সিটি করপোরেশন এলাকায় শিশু শ্রমিকের সংখ্যাও আড়াই লাখ। শিশু শ্রমিকদের ৯৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত থাকায় আইনি কাঠামো দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত নয়। গাড়ির গ্যারেজ, লেদ মেশিন, ওয়ার্কপ, ঝালাই কারখানা, প্লাস্টিক কারখানা, বেলুন ফ্যাক্টরি, হোটেল, প্রকাশনা ও বই বাধাই, জুতা কারখানা, গৃহকর্ম, বাস টেম্পু , শুটকি পল্লী, চিংড়ি পোনা ধরা, ইট ভাটা, কৃষি খাতে নিয়োজিত শিশুরা লেখাপড়া খেলাধুলা ও বিনোদন থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ঝুঁকিপূূূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুরা প্রায়ই দুর্ঘটনা, অস্থিরতার শিকার হচ্ছে। তারা শারিরীক নির্যাতন ও যৌন নিপীড়নেরও শিকার ।
আলোচনা সভায় আরও বলা হয় সরকার শিশু শ্রম বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ শিশু শ্রম বন্ধে দুই দশক ধরে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এরপরও শিশুশ্রম বাংলাদেশের অন্যতম সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর কারণ এ সংক্রান্ত আইন ও নীতিমালাা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা যায়নি। শিশু শ্রমের আইনি প্রতিরোধ ব্যবস্থা এখনও অনেকটাই সীমাবদ্ধ বলে উল্লেখ করা হয়।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন এবং শিশুশ্রম বিষয়ক একটি ভিডিও ক্লিপ প্রদর্শন করেন ‘উত্তরণ’ এর প্রকল্প সমন্বয়কারী হাসিনা পারভিন। এসময় বাংলাদেশের শিশুশ্রমের বর্তমান অবস্থা এবং তাদেরকে কোথায় কিভাবে শ্রমে বিনিয়োগ করে এক শ্রেণির মানুষ মুনাফা লুটে নিচ্ছে তা নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ছাড়াও পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধিরা। সভায় শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর, মহিলা অধিদপ্তর, শামস্ সহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন।