ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল, আমলা এবং সংসদ সদস্যদের নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে পুলিশের মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) দায়িত্ব পাওয়া একেএম শহীদুল হক।
২০১৪ সালে আওয়ামী লীগ টানা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের পর একেএম শহীদুল হককে ওই বছরের ৩১ ডিসেম্বর আইজিপির দায়িত্ব দেয়। আওয়ামী লীগ সরকারের তৃতীয় মেয়াদে ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারি অবসরে যান শহীদুল।
অবসরে যাওয়ার চার বছর পর আজ শনিবার রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরে কবি সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে নিজের লেখা ‘পুলিশ জীবনের স্মৃতি: স্বৈরাচার পতন থেকে জঙ্গি দমন’ গ্রন্থের প্রকাশনা উৎসবে সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক বললেন, ‘বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক শক্তি এবং আমলাতন্ত্র কখনো পুলিশের পরিবর্তন চাইবে না। এটা পরিষ্কার কথা, আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা।’
সাবেক আইজিপি বলেন, ‘ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল চায়- তারা যা বলবে পুলিশ তাই করবে; সংসদ সদস্য চান, তিনি যা বলবেন ওসি সেটাই করবেন। এসব চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে কাজ করা খুবই কঠিন।’
বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ নুরুল হুদা, কবি ও প্রধানমন্ত্রীর সাবেক মুখ্যসচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বইটির প্রকাশক দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহরুখ মহিউদ্দীন প্রমুখ।
পুলিশের সাবেক শীর্ষ কর্তা শহীদুল হক বলেন, ‘আমি রাজনৈতিক অপশক্তির কাছে মাথা নত করিনি। চেয়ার চেয়ে চাকরি করিনি, বদলি হয়েছে চলে গিয়েছি। চাকরিতে থাকা অবস্থায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছপা হইনি। তবে আমার মতো তো সবাই পারবে না। এজন্য একটা সিস্টেম বা পদ্ধতি চালু করা উচিত যাতে পুলিশ নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘বিচার ব্যবস্থার একটি অংশ পুলিশ। তারা যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেম কখনো কার্যকর হবে না। পুলিশ যদি নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে না পারে, তাহলে সুষ্ঠু তদন্ত সম্ভব না।’
‘পুলিশকে ঢেলে সাজানোর কথা বলা হয়। তবে এটা পলিটিক্যাল কথা, কীভাবে ঢেলে সাজাতে হয় সেটা আমি জানি না।’
পুলিশকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হলে আইনের সংস্কার প্রয়োজন বলে উল্লেখ করেন বাহিনীটির সাবেক এই আইজি। তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকাকালে উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হয়নি। সেখানে পুলিশ কমিশন গঠনের প্রস্তাব যেমন ছিল, তেমনি পুলিশ কমপ্লেইন কমিশন গঠনেরও প্রস্তাব ছিল। পুলিশের বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে একটি স্বাধীন স্বতন্ত্র সংস্থা সেটা তদন্ত করবে। কিন্তু সেটা হয়নি আমলাদের কারণে। আর রাজনীতিকরা তো চাইবেই না।’
‘যদি রাজনৈতিক এবং আমলাদের মন-মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটে তাহলে সুশাসন যে কথাটা সেটা শুধু স্লোগানের মধ্যেই থাকবে।’
সাবেক এই আইজিপি আরও বলেন, ‘পুলিশকে অনেক বৈরী পরিবেশের মধ্যে কাজ করতে হয়। সবাই পুলিশের সেবা চায়, কিন্তু কেউ পুলিশকে পছন্দ করে না। পুলিশকে ভয় পায়, কিন্তু পুলিশকে ভালো জানে না। আমি বইতে লিখেছি, বাতাসের মধ্যে বসবাস করি বলে অক্সিজেনের অভাব অনুভব করি না। তেমনি সমাজে পুলিশ আছে বলে এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি না। সরকার যদি ঘোষণা দেয়, দুই ঘণ্টার জন্য পুলিশের কোনো কার্যক্রম থাকবে না, তাহলে দেশে কী পরিস্থিতি হবে সেটা আমরা অনুভব করি না।’
‘পুলিশকে বুঝতে হলে পুলিশের কাছে যেতে হবে। পুলিশকে আস্থায় নিতে হবে। সেইসঙ্গে পুলিশকেও প্রচলিত ঔপনিবেশিক মন-মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। দুটোরই পরিবর্তন দরকার।’