খুলনা, বাংলাদেশ | ৩০ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১৫ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  খাগড়াছড়ির দীঘিনালাতে যুবকের গুলিবিদ্ধ মরদেহ উদ্ধার
  এইচএসসি পরীক্ষা ফল আজ, থাকছে না আনুষ্ঠানিকতা

দু’দফা খননের পরও প্রাণ ফিরে পায়নি প্রাণসায়ের খাল, জলবায়ু ফান্ডের টাকা নয়ছয়ের অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক, সাতক্ষীরা

দুই দফায় খননের পরও প্রাণ ফিরে পায়নি সাতক্ষীরা শহরের বুক চিরে প্রবাহিত ঐতিহ্যবাহি প্রাণসায়ের খাল। খালের পানির কোন প্রবাহ নেই। স্থানে স্থানে ময়লা আর্বজনায় ভরে উঠেছে। পুরো খাল কচুরিপনায় ভরে বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে। ফলে জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় সাতক্ষীরা পানি উন্নয়ন বোর্ড (পওর) বিভাগ-১ এর অধীনে প্রাণসায়ের খাল নামমাত্র খনন করে প্রকল্পের বেশির ভাগ টাকাই লোপাট করার অভিযোগ উঠেছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর বেইজলাইন প্রতিবেদন ২০১৫ অনুযায়ী জানা গেছে, বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড, সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-১ এর অধীনে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সাতক্ষীরা জেলার পোল্ডার-১ এর পুনর্বাসন শীর্ষক প্রকল্পটি জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের আওতায় ২০১২-১৩ অর্থবছরে ১১ কোটি ৪ হাজার ৬৪৫ টাকায় ১০ কিলোমিটার প্রাণ সায়ের খাল খনন করা শুরু হয়ে ২০১৫ সালে শেষ হয়।

প্রকল্পটির অনিয়ম নিয়ে টিআইবি জানায়, সাতক্ষীরা পাউবো’র অধিকাংশ ঠিকাদার ইট ভাটা ব্যবসার সাথে জড়িত। এর ফলে খনন কাজের মাটি খালের পাড়ে না দিয়ে অধিকাংশই নিজের ইটভাটায় বিনা খরচে বা অন্য ইটভাটায় বিক্রি করার মাধ্যমে সরকারি টাকায় নিজের ব্যবসার প্রসার ঘটিয়েছে। শহরের ইটাগাছাতে প্রকল্প কাজে ফাঁকি দেওয়ার জন্য খননযন্ত্র দিয়ে (এস্কেবেটর) খনন করা হয়েছে এবং খনন যন্ত্র দিয়ে শুধু খালের পাশে আগাছা কেটেছে, মাটি কাটেনি।

খালের ভেতর থেকে অল্প নরম মাটি টেনে এনে দুই পাড়ে দিয়ে ড্রেজিং করা হয়েছে। উত্তর কুলিয়াতে খাল থেকে সামান্য পরিমাণ মাটি কাটা হয়েছে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সাতক্ষীরা পওর বিভাগ-১ এর অধীনে ৬৪টি জেলার অভ্যন্তরস্থ ছোট নদী, খাল ও জলাশয় পুনঃখনন প্রকল্পের (১ম পর্যায়) আওতায় প্রাণসায়ের খালের ১৪ কিলোমিটার খনন করা হয় ১০ কোটি ১৩ লাখ টাকা ব্যয়ে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর খুলনা বিভাগীয় সমন্বয়ক মোঃ ফিরোজ উদ্দিন বলেন, সাতক্ষীরা বাসীর দীর্ঘদিনের দাবি ছিল প্রাণসায়ে খাল প্রাণ ফিরে পাবে। কিন্তু দাবি আছে দাবি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিকল্পনা ও বাজেটে জনগণের কোন সম্পৃক্ততা নেই। প্রকল্প যখন হাতে নেওয়া হয় তখন সাধারণত স্থানীয় জনগণ যারা এই প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করবে তাদের একটি দাবি থাকে দীর্ঘদিনের, সেই দাবিটা প্রাণ সায়েরের প্রাণ ফিরিয়ে আনার জন্য ছিল। কিন্তু যখন দাবিটা বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ করলো যেমন, প্রকল্প গ্রহণ ও প্রকল্পের বরাদ্দ এবং বাস্তবায়নে সাধারণ মানুষের উপস্থিতি ছিলনা। অর্থাৎ কোন একটি কাজকে উন্নয়নের ধারায় নিয়ে যেতে চাইলে সেখানে অবশ্যই স্থানীয় মানুষের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। কিন্তু আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে সম্পৃক্ততা ছিল না। কাজটি যখন করা হলো তখন সেই কাজ কিভাবে করলে এর স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পাবে বা টেকসই হবে, সেই পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিনা আমার সন্দেহ আছে।

তিনি আরও বলেন, ২০১৫ সালে যখন কাজটি শেষ হয়েছে তখন দেখেছি কিছুদিন পরে খালটি আবার আগে মতো যা তাই হয়ে গেছে। দ্বিতীয় দফায় ২০২০ সালেও যখন কাজটি শেষ হলো খুব কম সময়ে আমরা দেখেছি সেই একই রকম, কোন সুফল আমরা পাচ্ছিনা। অতএব এখানে বুঝতে হবে যেভাবে কাজটি করার কথা ছিল সেভাবে করা হয়নি। এখানে যারা কাজ করেছে যারা সম্পৃক্তত ছিল তাদের স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতার ঘাটতি রয়েছে। কোন একটি প্রকল্প উন্নয়ন কাজকে টেকসই করতে হলে, জনগণের সুফল সম্পূর্ণভাবে দিতে হলে ওই কাজের সাথে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ ও যারা কাজটি করছে তাদের দায়বদ্ধতা, তাদের সচ্ছতা এগুলো না থাকলে এই কাজ গুলোর সুফল আসবে না। এই কাজটিতে সচ্ছতার অভাব ছিল, জনগণের অংশগ্রহণ ছিলনা। জলবায়ু অর্থায়নে চাই সচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অংশগ্রহণ।

সাতক্ষীরা জলবায়ু পরিষদের সদস্য সচিব অধ্যক্ষ আশেক-ই-এলাহী বলেন, ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে এ খাল খননের নামে অর্থ অপচয় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান লাভবান হয়েছে। প্রাণ সায়ের খাল খননের ফলে নগরবাসী কোন ধরনের সুফল পেয়েছে বলে আমার মনে হয় না, যার কারণ হচ্ছে খালটি খননের পরে রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়নি, তার সাথে আরও একটি হচ্ছে পানির একটা প্রবাহ সৃষ্টি হওয়ার কথা সেটাও হয়নি। নকশা অনুযায়ী খাল কাটা হয়নি। যেনতেন উপায়ে কাদা তুলে পাড়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, নামমাত্র খাল খনন করা হয়েছে, এখন বর্তমানে খালে যে পানি রয়েছে সেটা পঁচা। পুরো খাল কচুরিপনায় ভরে গেছে। খালের পানির কোন প্রবাহ নেই। আমার মনে হয়নি কাজটা সঠিক ভাবে হয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, আমরা যেটা বুঝি জলবায়ু পরিবর্তন ফান্ডের টাকার কাজটি স্থায়িত্ব হবে, কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। খালটি যেভাবে খননের কথা ছিল সেভাবে হয়নি। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের প্রজেক্টের টাকা নয়ছয় হয়েছে, খাল খননে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে।

জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক অধ্যক্ষ আনিসুর রহিম বলেন, পানি উন্নয়ন বোর্ড আর ঠিকাদারদের মধ্যে চুরি হয়েছে। জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ডের টাকা নয়ছয় করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। দুই দফায় খননের পরও আজ খালটি বদ্ধ জলাশয়ে পরিণত হয়েছে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি কর্তৃপক্ষ। শুধু এই দুবার না এর আগে এ কয়েকবার খাল খননের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আসলে কতৃপক্ষ অর প্রশাসনের এটা দেখভাল করার কথা ছিল, কিন্তু এটা কেউই দেখভাল করেনি। এখন কচুরিপানায় খালটা আবার ভরে গেছে। তাহলে সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পের স্থায়িত্ব কোথায়?।

সাতক্ষীরা পানি উন্নয় বোর্ড বিভাগ-১ এ নির্বাহী প্রকৌলশলী (সাবেক) মোঃ আবুল খায়ের বলেন, দ্বিতীয় দফায় ১৪ কিলোমিটার প্রাণ সায়ের খাল খননে বরাদ্দ ছিল ৭ কোটি টাকা। কিন্ত ঠিকাদার নানাবিধ সমস্যার কারণে শহরের ভেতরের খাল খনন করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এস্কেবেটর মেশিন দিয়ে খাল খনন করা হয়েছে। এসময় এস্কেবেটর মেশিন ব্যবহার করতে গিয়ে বিদ্যুতের তার কেটে গেলে ক্ষতিপুরণ দিতে হবে, পৌরসভার রাস্তার ক্ষতি হলে তা ঠিক করে দিতে হবে, রাস্তায় মাটি পড়লে পরিষ্কার করে দিতে হবে, এতসব প্রতিবন্ধকতার কারণে ঠিকাদার শহরের মধ্যে সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি। তবে শহরের বাইরে কাজ ভাল হয়েছে।

নানা প্রতিবন্ধকতার পরও এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, পুরো কাজ না হওয়ায় ঠিকাদার বিল পেয়েছেন মোট বরাদ্দের মাত্র ৩০ শতাংশ টাকা। প্রাণসায়ের খাল খননে কোন দূর্নীতি ও অনিয়ম হয়নি বলে দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!