খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ডেঙ্গুতে একদিনের ৯ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১ হাজার ২১৪

দু’কক্ষ আইনসভা ও প্রাসঙ্গিক ভাবনা

অধ্যাপক শেখ দিদারুল আলম

বর্তমান সময়ে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর কার্যতালিকা বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এর সাথে সাথে সরকারের তিনটি বিভাগের কাজের চাপ গত এক দশকে পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। এজন্য শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ ও আইন বিভাগকে অনেক সময় কাজের চাপে হিমসিম খেতে হয়। বর্তমান রাষ্ট্র পুলিশী রাষ্ট্র নয়, জনকল্যাণ মুখী রাষ্ট্র। আর বর্তমান রাষ্ট্রগুলো জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র বলেই রাষ্ট্র জনগণের কথা ভেবেই কোন কোন রাষ্ট্র বিচার বিভাগকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার জন্য বিকেন্দ্রীকরণ করছে, শাসন বিভাগের একটি মন্ত্রাণালয় ভেঙে কয়েকটি মন্ত্রানালয় বা অধিদপ্তর সৃষ্টি করছে। কোন রাষ্ট্র তার আইনসভাকে এককক্ষ থেকে দু’কক্ষ আইনসভায় রুপান্তর করছে।
বাংলাদেশ পৃথিবীর বাইরে নয় এবং বাংলাদেশ জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই একটি মন্ত্রাণালয় থেকে কয়েকটা মন্ত্রাণালয় বা অধিদপ্তরের জন্ম দিয়েছে কাজের সুবিধার জন্য। এসব মন্ত্রাণালয় বা অধিদপ্তরে মন্ত্রী ও সচিব রয়েছেন। এখন সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল ও জনগণের দাবি উঠেছে বাংলাদেশের আইনসভা বা জাতীয় সংসদকে দু’কক্ষ বিশিষ্ট করা। আজকের বিশ্বে Good Government কথাটি বার বার উচ্চারিত হচ্ছে। তার অন্যতম উপাদান জাতীয় সংসদকে দু’কক্ষ বিশিষ্ট করা। এর একটি জাতীয় সংসদের নিম্ন কক্ষ, অপরটি জাতীয় সংসদের উচ্চ কক্ষ।
এখন জানতে হবে দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা বলতে আমরা কি বুঝি? সাধারণভাবে বলা যায় আইনসভার দুইকক্ষ থাকলে তাকে দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা বলে। অন্যভাবে বলা যায় সরকারের আইনসংক্রান্ত কার্যাবলী যখন আইনসভার দু’কক্ষের মাধ্যমে আলোচিত হয় ও সম্প্রসারিত হয় তখন তাকে দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা বলা হয়। এক কথায় সরকারের আইন প্রণয়নের কাজটি যখন দুটি পরিষদের মাধ্যম সম্পাদন হয় তখন তাকে দি কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভা বলে।
রাষ্ট্র চিন্তাবিদ ও দার্শনিক লড ব্রাইস, জন এস মিল, লড এ্যাকটন, হেনরি গেইল প্রমুখ দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সমার্থক।
ব্রিটিশ আইন সভা বা পার্লামেন্টকে আইন সভার জননী বা Mother of the Parament বলা হয়।
ব্রিটিশ আইনসভা সর্ব প্রথমে দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা প্রবর্তন করে। উচ্চ কক্ষকে বলা হয় লর্ডসভা। নিম্ন কক্ষকে বলা হয় জনপ্রতিনিধি সভা। লর্ডসভার সদস্যরা বিভিন্ন প্রতিনিধিত্বশীল গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে মনোনীত হন। আর কিছু অংশ জনগণের ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হন। জনপ্রতিনিধি সভার সদস্যরা জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচিত।
পরবর্তীকালে ব্রিটিশ আইনসভার পথ ধরে গণতন্ত্রকে আলেকিত করার জন্য বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে চালু হয়েছে দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা। বিশ্বের বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোসহ ( শুধু চীন বাদে) প্রায় শতাধিক দেশে দু’কক্ষ আইন সভা রয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম বৃটেন, আমেরিকা, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মান, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল অন্যতম। গণচীন, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ইরান, ইরাক, ভিয়েতনাম সহ প্রায় শতাধিক দেশে এক কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা বিদ্যমান।
পৃথিবীর দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার মধ্যে সর্ববৃহৎ আইন সভা বৃটেনের। এর পরেই জার্মানীর । ২৫ সদস্য নিয়ে পালাউ জাতীয় কংগ্রেস সবচেয়ে ছোট দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা। আর ভ্যাটিকান সিটির আইনসভা ৭ সদস্য নিয়ে গঠিত। যারা সকলেই ধর্মীয় নেতা পোপ মনোনীত।
দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভার করার পিছনে যুক্তি সমুহ :
(১) সুচিন্তিত আইন প্রণয়ন : আইন সভা হলে উভয় পরিষদ আলাপ আলোচনা ও তর্ক বির্তকের মাধ্যমে সুচিন্তিত ও জনকল্যাণমুখী আইন প্রণয়ন করতে পারে। উভয় পরিষদ নিয়ন্ত্রণমূলক, সচেতনমূলক, সংস্কারমূলক এবং সংযতকারী ক্ষমতা একে অপরের জন্য অপরিহার্য।
(২) একদলীয় একনায়কতান্ত্রীক প্রবণতা রোধ : আইন সভা এক কক্ষ হলে যে দল আইনসভায় নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে তারা সংসদের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র কায়েম হবে। ফলে দলটি হয়ে উঠে নব্য স্বৈরাচার। তারা জনগণের কথা না ভেবে দল ও নিজের লাভ লোকসানের হিসেব করে।
(৩) সংখ্যালঘুদের স্বার্থের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেয়া : উচ্চ কক্ষে যেহেতু মনোনয়ন মাধ্যমে বা পরোক্ষভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি বাছাই করা হয়। সেহেতু সব গোষ্ঠীর প্রতিনিধি আইন সভায় থাকায় সংখ্যালঘু বা বিভিন্ন গোষ্ঠীর সুখ দুঃখ, চাওয়া পাওয়া কথা আইন সভায় উঠে আসে।
(৪) সমাজের শিক্ষিত ও গুণীমানুষের প্রতিনিধিত্ব : মনোনয়ন মাধ্যমে সমাজের গুণী মানুষের প্রতিনিধি পাঠানো সহজ হয় এই প্রক্রিয়ায়।
(৫) রাজনৈতিক শিক্ষার বিস্তার : আজকের ডিজিটাল যুগে আইনসভার বিভিন্ন প্রতিনিধির বক্তব্য বিভিন্ন মিডিয়া তথা সামাজিক মিডিয়ায় প্রচারের মাধ্যমে জনগণ রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠে এবং রাজনৈতিক শিক্ষা লাভ করে।
(৬) কাজের চাপ হ্রাস : আইন সভা দু’কক্ষ হলে আইন সভার কাজের চাপ হ্রাস পায়। ফলে যে কোন প্রস্তাবিত আইন নিয়ে তড়িঘড়ি করা লাগে না। ভেবে চিন্তে আইন পাশ করা যায়।
(৭) বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ : উচ্চ পরিষদে বিভিন্ন পেশার মানুষের প্রতিনিধি থাকায় বিশেষজ্ঞরা সহজে জনগণের উপকারের জন্য তাদের মতামত তুলে ধরতে পারে।
(৮) জনমতের গতি প্রকৃতির প্রতিফলন : অনেক দেশে উচ্চ পরিষদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় বিভিন্ন সময়। ফলে নিম্ন পরিষদের সদস্যরা উচ্চ পরিষদের নির্বাচনের ফলাফল দেখে জনমত সম্পর্কে আগে ভাগে জানতে পারেন। এতে জনকল্যাণমুখী হয় সরকার।
সবশেষে বলা যায়, দু’কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা থাকলে সরকার ও রাষ্ট্র জনকল্যাণমুখী হয়। হটকারিতামুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়। আইন প্রণয়নে আবেগ থাকে না। থাকে যুক্তি ও যুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা।
লেখক : ইউএনবি, খুলনা প্রতিনিধি ও যুগ্ম সম্পাদক, খুলনা গেজেট।




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!