‘দীপ’ এবং ‘অবলি’ – এই দুইয়ে মিলে গঠিত হয়েছে সংস্কৃত দীপাবলি শব্দটি। ‘দীপ’ শব্দের অর্থ ‘আলো’ এবং অবলি শব্দের অর্থ ‘সারি। অর্থাৎ এই শব্দের অর্থ আলোর সারি বা প্রদীপের সমষ্টি। বাংলাদেশে একদিনেই এই আলোক উৎসব উদযাপিত হলেও ভারতে একদিন নয় – পাঁচ দিন ধরে পালিত হয় এই উৎসব। ধনতেরাস, নরক চতুর্দশী বা ভূত চতুর্দশী, অমাবস্যা, কার্তিক শুদ্ধ পদ্যমী বা বালি প্রতিপদা এবং ভাইফোঁটা। ভারত উপমহাদেশ ছাড়াও ত্রিনিদাদ & টোবাগো, মায়ানমার, মরিশাস, নেপাল, গায়ানা, সিঙ্গাপুর, সুরিনাম, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা এবং ফিজিতেও উৎসাহ উদ্দীপনার সাথে দীপাবলি উদযাপন করা হয়।ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরেও দীপাবলি উৎসব বেশ ঘটা করে ধুমধামের সাথে বড় পরিসরে পালিত হয়।
আশ্বিন মাসের কৃষ্ণা ত্রয়োদশীর দিন ধনতেরাস অথবা ধনত্রয়োদশী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে দীপাবলি উৎবের সূচনা হয়। কার্তিক মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই উৎসব শেষ হয়। নবরাত্রি উৎসব তথা বাঙালিদের দুর্গোৎসব শেষ হওয়ার ১৮ দিন পর দীপাবলি শুরু হয়। এই বছর আশ্বিন মাসটি মলোমাস হওয়ায় দুর্গাপূজা সহ দীপাবলি উৎসব পালিত হচ্ছে কার্তিকে। উৎসব পর্ব শুরু হয় ত্রয়োদশী থেকে৷ এই দিন পালিত হয় ধনতেরাস৷ ধনতেরাসে ধনদেবতা কুবেরের পুজো করা হয়৷ এই দিন সোনা বা কোনও ধাতু কেনা শুভ৷ তাই পুজো না করলেও এই দিন স্বর্ণ কিনেন অনেকেই৷
সনাতন ধর্মাবলম্বীগণ বিশ্বাস করেন যে, এই দিন যা কেনা হয় তার দ্বিগুণ লাভ হয় জীবনে৷ মহারাষ্ট্র ও দক্ষিণ ভারতে চতুর্দশীর দিন পালন করা হয় ছোটি দিওয়ালি৷ এই দিন সত্যভামার হাতে নিহত হন নরকাসুর৷ তাই এই দিনকে নরক চতুর্দশীও বলা হয়৷ দিনটিকে ভূত চতুর্দশী হিসাবেও কোথাও কোথাও পালন করা হয়। এই দিনে বাঙালি হিন্দুগণ বাড়ির ১৪ টি এঁদো কোণায় ১৪ টি প্রদীপ জ্বালিয়ে অন্ধকার মুছিয়ে আলোকিত করে তোলেন বাড়িকে। লোককথায় শোনা যায় যে, এই প্রদীপসজ্জার মাধ্যমে পরিবারের পিতৃপুরুষদের অনুষ্ঠানে পদার্পণ করার জন্য নিমন্ত্রণ পাঠানো হয়, যাতে তাঁরা কালী দেবীর বাৎসরিক আগমনে উপস্থিত হয়ে সবাইকে শুভাশীষ দিয়ে নিজেরা মায়ের আশীর্বাদে মোক্ষ লাভ করবেন।
দীপাবলি পালিত হয় অমাবস্যায় তথা ভূত চতুর্দশীর পরের দিন। বিশ্বাস করা হয় যে, ১৪ বছর বনবাসে কাটিয়ে এইদিন অযোধ্যায় ফিরেছিলেন শ্রী রামচন্দ্র৷ তাই রামচন্দ্রের পথ আলোকিত করতেই অমাবস্যার রাত সেজে উঠেছিল আলোয়৷ এই দিন সুখ-সমৃদ্ধির জন্য একসঙ্গে তাই লক্ষী-গণেশ পুজোও করা হয়৷ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে দীপাবলি একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দিন ঘিয়ের প্রদীপ জ্বেলে সাজিয়ে তোলা হয় চারপাশ। এই প্রদীপ জ্বালানো অমঙ্গল বিতাড়নের প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়। দিনটিতে পূর্বভারত বাদে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষে এবং বাংলদেশেও লক্ষ্মী-গণেশের পূজার নিয়ম আছে। জৈন মতে, ৫২৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহাবীর দীপাবলির দিনেই মোক্ষ বা নির্বাণ লাভ করেছিলেন। ১৬১৯ খ্রিস্টাব্দে শিখদের ষষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ ও ৫২ জন রাজপুত্র দীপাবলির দিন মুক্তি পেয়েছিলেন বলে শিখরাও এই উৎসব পালন করেন। আর্য সমাজ এই দিনে স্বামী দয়ানন্দ সরস্বতীর মৃত্যুদিন পালন করেন। তাঁরা এই দিনটি “শারদীয়া নব-শস্যেষ্টি” হিসেবেও পালন করেন।
বাংলাদেশসহ পশ্চিম বাংলা, আসাম, ওড়িশা ও মিথিলাতে এই দিন দীপান্বিতা কালীপুজা বা শ্রী শ্রী শ্যামাপূজারও প্রচলন রয়েছে। এই উৎসব সাড়ম্বরে আলোকসজ্জা সহকারে পালিত হয়। তবে এই পূজা কিন্তু প্রাচীন নয়। ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথ রচিত শ্যামাসপর্যা বিধিগ্রন্থে এই পূজার সর্বপ্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়। কথিত আছে যে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় অষ্টাদশ শতকে তাঁর সকল প্রজাকে শাস্তির ভীতিপ্রদর্শন করে কালীপূজা করতে বাধ্য করেন। সেই থেকে নদীয়ায় কালীপূজা বিশেষ জনপ্রিয়তা লাভ করে। কৃষ্ণচন্দ্রের পৌত্র ঈশানচন্দ্রও কালীপুজোর আয়োজন করতেন। ঈশ্বরীয় আবেশে ভরা দীপান্বিতা। এ নামের মধ্যে রয়েছে ইতিহাস ও পুরাণের অভিবন্দনা। উচ্ছ্বাসের সাথে আছে হৃদয় থেকে উৎসারিত অফুরন্ত আনন্দের প্রজ্বলিত আলোকমালা। আজ ১৪ নভেম্বর- বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সেই দীপাবলি উৎসব ও শ্রী শ্রী শ্যামাপূজা।
খুলনা গেজেট/কেএম