সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিমের দু’প্রান্তে শরণখোলা থেকে শ্যামনগর পর্যন্ত হরিণ শিকারীরা খুবই তৎপর। বন সংলগ্ন এলাকার হরিণ শিকারী হিসেবে কালো তালিকা করেছে বন বিভাগ। রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে শিকারীরা। বনে হরিণের সংখ্যা দিনে দিনে কমছে। ফলে বাঘের খাদ্য শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ছে।
সর্বশেষ রবিবার (১৭ মার্চ) কোস্টগার্ডের এর অভিযানে, কয়রার দক্ষিণ খাসিটানা, শেকবাড়িয়া নদী সংলগ্ন এলাকা, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানাধীন সুন্দরবন বাজার ও আশপাশের এলাকা এবং মোংলার জয়মনিরগোল এলাকায় অভিযান চালিয়ে সুন্দরবন থেকে অবৈধভাবে শিকারকৃত মোট ২০৫ কেজি হরিণের মাংস, ২টি মাথা, ২টি চামড়া ও ৮টি পাসহ এক জনকে আটক করা হয়।
বন বিভাগের তথ্য সূত্রে জানা যায়, চলতি অর্থ বছরের এ পর্যন্ত সুন্দরবনের পশ্চিম বন বিভাগের আওতাধীন এলাকা থেকে ৪৪৭ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়েছে। এতে মামলা হয়েছে ৩২ টি, আসামি হয়েছেন ৭৫ জন। এছাড়া ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে ৫১৪ কেজি ও ২০২২-২৩ অর্থ বছরে ৫২৩ কেজি হরিণের মাংস উদ্ধার করা হয়েছে।
কেরামত আলি নামে এক হরিণ শিকারী জানান, হরিণের মাংসসহ বন বিভাগের হাতে আটক হয়ে সাজাভোগ করেছি। এখন এই পেশা ত্যাগ করেছি। যে পরিমাণ হরিণের মাংস ও চামড়া জব্দ হয়, তার থেকে কয়েকগুণ বেশি হরিণ শিকার করা হয়। এর ক্রেতা হলেন টাকাওয়ালারা। অনেক সময় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা এমনকি সরকারি কর্মকর্তারাও আমাদের কাছ থেকে হরিণের মাংস কিনতেন। তারা শখের বসে হরিণের মাংস খেতে চান। আবার কেউ কেউ স্বজনদেরও মাংস উপহার দেন।
তিনি বলেন, হরিণ শিকারের জন্য নাইলনের দড়ির ফাঁদ ব্যবহার করা হয়। সাধারণ সুন্দর বনের গহীনে বেশি হরিণ শিকার করা হয়। বাজারে প্রতি কেজি হরিণের মাংসের মূল্য ৬০০ টাকা হারে বিক্রি হচ্ছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়রার এক হরিণ শিকারী বলেন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা কর্মীরা তাদের বড় নেতাদের খুশি করার জন্য মাংস দেওয়ার অনুরোধ করে। কোন সমস্য হলে তারা দেখবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দেয়। কয়েকবার আটক হয়েছি।
স্থানীয়দের তথ্য মতে, খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের আংটিহারা ও জোড়শিং এলাকায় হরিণ শিকারি চক্রের আধিপত্য বেশি। আর হরিণ পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বজবজা ও খাসিটানা বন টহল ফাঁড়ি এলাকা। এছাড়া মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের নয়ানি, হড্ডা, বানিয়াখালী, শেখেরকোনা ও তেঁতুলতলার চর, কয়রা সদর ইউনিয়নের ৪ নম্বর, ৫ নম্বর ও ৬ নম্বর কয়রা; উত্তর বেদকাশী ইউনিয়নের পাথরখালী, কাটকাটা; মহারাজপুর ইউনিয়নের পূর্ব মঠবাড়ি, মঠেরকোনা গ্রামে হরিণ শিকারি চক্রের তৎপরতা রয়েছে। দাকোপ উপজেলার ঢাংমারী, খাজুরা, বানীশান্তা, সুতারখালী ও কালাবগি গ্রামের চিহ্নিত হরিণ শিকারিরা রাতে ও দিনে দলবদ্ধভাবে সুন্দরবনে প্রবেশ করে নিয়মিত হরিণ শিকার করে।
বর্তমানে বন বিভাগের অভিযানে কিছু হরিণ শিকারী ও হরিণের মাংস উদ্ধার হচ্ছে। তবে গত ৫ আগষ্টের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা কমে গেলে বনে ব্যাপক হারে হরিণ শিকার শুরু হয়েছিল।
সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জের অধীনের একটি ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আগষ্ট মাস আমরা দেখেছি, নৌকা ভর্তি করে স্থানীয়রা হরিণ শিকার করে নিয়ে যাচ্ছেন। তবে ওই সময়ে পরিস্থিতি এমন ছিল যে, আমরা কাউকে আটকের সাহস করে উঠতে পারিনি। এখন আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতিত স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি। বনের মধ্যে একটি টহল ফাঁড়িতে মাত্র ৪ বা ৫ জন বনরক্ষী কাজ দায়িত্ব পালন করেন। তাদের পক্ষে ১০ থেকে ১২ জনের একটি হরিণ শিকারীদের প্রতিহত করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়।
সুন্দরবনের টাইগার অ্যাকশন প্লানের বলা হয়েছে, একটি টেরিটরিতে একটি বাঘের জন্য কমপক্ষে ৫০০ টি হরিণ থাকা জরুরী। ২০২৩ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজের নেতৃত্বে সুন্দরবনের বাঘের শিকার প্রাণি ওপরে একটি গবেষণায় করা হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে, বাঘের ৭৯ শতাংশ খাবার হয় চিত্রা হরিণ থেকে। গবেষণা জরিপ মতে, সুন্দরবনে চিত্রা হরিণ ছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩৫৭ টি।
এর আগে ১৯৮০ সালে একবার বাঘের খাবার নিয়ে সুন্দরবনে জরিপ হয়েছিল, সেই সময়ে চিত্রা হরিণ ছিল ৮০ থেকে ৮৫ হাজার।
বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘ শিকারের প্রজাতির অবস্থা শীর্ষক গবেষণায় অধ্যাপক এম এ আজিজ জানিয়েছেন, বাঘ হল সুন্দরবনের প্রাকৃতিক রক্ষক। আর বাঘ সংরক্ষণ করতে হলে, তার খাবার রক্ষার উপর জোর দিতে হবে।
হরিণ শিকারীদের তৎপরতার বিষয়ে খুলনার বন সংরক্ষক ইমরান আহমেদ বলেন, ইতোমধ্যে বিষয়টি আমি অবগত হয়েছি। শুষ্ক মৌসুমে সুন্দরবনের ভেতরে খাল ও নদীতে পানি শুকিয়ে যাওয়ায় হরিণের বিচরণ বেড়ে যায়। যে কারনে চোরা শিকারীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এসব শিকারীদের ধরতে বন বিভাগ তৎপর রয়েছে। এবং স্থানীয়দের সহযগিতায় শিকারীদের তালিকা করা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের চিত্রা হরিণ কেবল প্রকৃতির সৌন্দর্যের অংশ নয়, এটি বনাঞ্চলের পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শিকার ও পাচারের লাগাম টানতে হলে আমাদের পাশাপাশি স্থানীয় জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এই জন্য আমরা স্থানীয়দের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ড্রোন প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছি।
খুলনা গেজেট/এমএম