গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে জার্মান বেতার ‘ডয়েচে ভেলে’ বাংলাদেশে সাংবাদিকতার অবস্থার ওপর এক আলোচনায় নানা পর্যায়ে তোষামোদ করার প্রবণতার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। তাতে অনেক কথার মধ্যে বিশেষভাবে বলা হয়েছে, “বেশিরভাগ গণমাধ্যমই পরিমিতির জায়গাটা রাখতে পারেনি৷ সাংবাদিকেরা যে ভাষায় তোষামোদ করে কথা বলেন সেই ভাষা সাংবাদিকতার সঙ্গে যায় কিনা সেটা ভেবে দেখবার মতো বিষয়৷”
কে ভাববে? ভাবার প্রয়োজনই বা কি? বিশ্বের সর্বত্র সাংবাদিকতায় তোষামোদ মুখ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। এটিই বরং কল্লা বাঁচানোর ও ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার বড় উপায়।
সংজ্ঞা ও দৃষ্টান্ত অনুযায়ী তোষামোদকারীরা “এমন ব্যক্তিগণ, যারা সমাজে বা পেশায় নিজেদের তাৎপর্যহীন বলে অনুভব করেন, এবং নিজেদেরকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার উদ্দেশ্যে ক্ষমতার অধিকারী অথবা বিত্তবান লোকজনের এমন প্রশংসা করেন, যার মধ্যে কোনো আন্তরিকতা থাকে না। এ ধরনের অর্থহীন ও আন্তরিকতাশূন্য প্রশংসার উদ্দেশ্য সাধারণত তাদের নিকট থেকে সুবিধা আদায় করে নেয়া।”
তোষামোদকারীদের জনপ্রিয়ভাবে ‘বুটলিকারস’ বা ‘জুতা লেহনকারী’ অথবা “অ্যাস-লিকারস” বা “পশ্চাদ্দেশ লেহনকারী’ও বলা হয়। এ সম্পর্কে আমার নিজস্ব কোনো বক্তব্য নেই। আমি শুধু বিখ্যাত ক’জন ব্যক্তি এবং একটি সংবাদপত্রের রিপোর্টের একাংশ উপস্থাপন করছি:
বারাক ওবামার বক্তব্য:
বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর শেষ সাংবাদিক সম্মেলনে (১৮ জানুয়ারি ২০১৭) স্বাধীন গণমাধ্যমের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেছিলেন,“আপনাদের তো তোষামোদকারী হওয়ার কথা নয়। আপনাদের সংশয়বাদী অনুসন্ধিৎসু হওয়ার কথা, আমাকে তো আপনাদের কঠিন প্রশ্ন করার কথা।”
সাংবাদিকদের একটি অংশ, বরং বলা চলে সাংবাদিকদের বৃহৎ অংশটিই যে তোষামোদি, অথবা সোজা বাংলায় ধান্দাবাজিতে লিপ্ত, তা রাখঢাক করার মতো প্রসঙ্গ নয়। এ তোষামোদি তৃতীয় অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বেশি, উন্নত দেশগুলোতে হয়তো একটু কম। গণমাধ্যমের অবাধ স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের মহান দেশের তকমাধারী দেশ যুক্তরাষ্ট্রেও তোষামোদকারী বা ধান্দাবাজ রয়েছে ভেবে আমরা আত্মপ্রসাদ লাভ করতে পারি যে, ‘আমেরিকার সাংবাদিকরা যদি ধান্দাবাজ হয়, আমরা এক-আধটু হলে সমস্যা কোথায়?”
দ্য স্যাটারডে রিভিউ এর ১৮৬১ সালের রিপোর্ট:
তোষামোদির পক্ষে দৃষ্টান্ত গ্রহণের জন্য আমাদের দেশের সাংবাদিকরা ফরাসি দেশের অনেকে পুরোনো উদ্ধৃতিকে কাজে লাগাতে পারেন। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দ্য স্যাটারডে রিভিউ’ এর ১৮৬১ সালের ২৬ জুন সংখ্যায় এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছিল, “যে সুযোগ সুবিধা প্রদান করে সরকার সাহিত্য ক্ষেত্রে পুতুল এবং ফরাসি সাংবাদিকদের মধ্যে তোষামোদকারী খুঁজে পেয়েছেন, তাতে তাদের নির্বিচার নির্লিপ্ততার অর্ধেকটা প্রমাণিত হয়, যে কারণে সরকার তাদেরকে একটি শ্রেনি হিসেবে বিবেচনা করে।”
সাংবাদিক চলচ্চিত্রকার জনসনের বক্তব্য:
কানাডার খ্যাতিমান সাংবাদিক ও চলচ্চিত্রকার ব্রায়ান জনসন বলেছেন, “চলচ্চিত্র তারকারা ধনবান ও বিখ্যাত, সাংবাদিকরা তা নন, তবুও আমরা আমাদের ব্যবধানগুলো এড়ানোর ভান করি। সাংবাদিক সন্দেহভাজন, ছুরি গোপন করে রাখা তোষমোদকারী।
সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজিস্ট ওমের তাসপিনারের বক্তব্য:
ইউএস ন্যাশনাল ওয়ার কলেজের ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্র্যাটেজি’র প্রফেসর এবং ওয়াশিংটন ভিত্তিক ব্রুকিং ইন্সটিটিউটের সিনিয়র ফেলো, তুর্কি বংশোদ্ভুত ওমের
তাসপিনার বিবিসি ওয়ার্ল্ডওয়াইড এ এক প্রোগ্রামে অংশ নিয়ে বলেছেন, “প্রেসিডেন্টের (তুরস্কের প্রেসিডেন্ট) সাংবাদিক সম্মেলনগুলোতে উপস্থিত থাকা অথবা সরকারি সফরে বিদেশ গমণকারী সাংবাদিকরা আসলে সরকারের বাছাই করা বা নির্বাচিত সাংবাদিক, অর্থ্যাৎ যারা তোষামোদকারী। তারা কোনো বিদেশি সাংবাদিকের মতো কখনো সাহস করে এরদোয়ানকে কড়া কোনো প্রশ্ন করতে পারেন না।” (ফেসবুক ওয়াল থেকে)