খুলনা শিপইয়ার্ড সড়কে যাতায়াতকারী যানবাহনের চালক, ব্যবসায়ী এবং পথচারীদের দুর্ভোগের শুরুটা হয়েছিল ২০২২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যখন থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সড়কটি প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করে। এরপর কেটে গেছে ৩৬ মাস। শেষ হয়নি দুর্ভোগের যাত্রা। ৩৬ মাসে প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৭০ শতাংশ। কয়েক দফা সময় বৃদ্ধির পর চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। খুলনা ওয়াসার পয়ঃনিষ্কাশন পাইপলাইন স্থাপনের কাজ চলমান থাকায় সঠিকভাবে কাজ করতে পারছে না সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মাহবুব ব্রাদার্স প্রাইভেট লিমিটেড। চলতি ফেব্রুয়ারি মাসের ভিতর ওয়াসার কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ওয়াসার কাজ শেষ হতে সময় লাগবে।
ওয়াসার পয়ঃনিষ্কাশন প্রকল্পের পিডি জানিয়েছেন, ‘কিছু ইকুপমেন্টের অসুবিধার কারণে কাজটি ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে শেষ করা যাচ্ছে না। আশা করছি মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যেই শেষ হবে।’
এদিকে সড়ক প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় লবণচোরা আরসিসি ব্রিজের কাজ শেষ হওয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে বলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান সূত্রে জানা যায়। সড়কের ড্রেন নির্মাণের কাজও এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। সব মিলিয়ে চলতি বছরের ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পের বাকি ৩০ শতাংশ কাজ শেষ হওয়া নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এদিকে প্রকল্পের বাস্তবায়নকারী সংস্থা খুলনা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কেডিএ) ‘র ১৪৮ কোটি টাকার প্রকল্পটি সম্পন্ন নিয়ে মাথা ব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রবিবার (১৬ই ফেব্রুয়ারি) সড়কটির রুপসা ট্রাফিক মোড় হতে লবণচোরা রুপসা ব্রিজের নীচ পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের সড়কটির প্রশস্তকরণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ সরেজমিনে ঘুরে এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রুপসা ট্রাফিক মোড়ের কালভার্টে ঢালাইয়ের কাজের প্রস্তুতি চলছে। ২/১ দিনের মধ্যে ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হবে। মতিয়াখালি সুইচগেটের ঢালাইয়ের কাজের প্রস্তুতি চলমান। চলতি সপ্তাহের মধ্যে ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হবে। শিপইয়ার্ড স্কুল থেকে লবণচোরা সুইচ গেট পর্যন্ত ১ কিলোমিটার সড়কের বেজ টাইপ-২ ‘র কাজ চলমান রয়েছে। সড়কের দু’পাশে ড্রেনের টপ স্লাপের কাজ চলতি সপ্তাহের ভিতর সম্পন্ন হবে। রিটেনিং ওয়ালের কাজ চলমান, সংযোগ সড়কের পুরাতন ড্রেনের ওয়াল ভেঙ্গে ভার্টিক্যাল এক্সটেনশনের কাজ চলমান রয়েছে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে সড়কটির কাজ চলমান থাকায় গুরুত্বপূর্ণ এ সড়কটি দিয়ে যাতায়াতকারী যানবাহনের চালক, পথচারী এবং ব্যবসায়ীদের সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমী দুর্ভোগের এ মাত্রা দ্বিগুণ পরিমাণে বেড়ে যায়।
সড়কের মেসার্স টুটুল অটো পার্টস ও ব্যাটারির স্বত্বাধিকারী মোঃ ইব্রাহিম হোসেন খুলনা গেজেটকে বলেন, দীর্ঘ তিন বছর সড়কের দুর্ভোগের কারণে দুইবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন করতে হয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। টানা এক বছর শুধু ড্রেন খোঁড়াখুড়ির কাজ চলেছে। সড়কের এই দুরাবস্থার কারণে শুধু আমি নয় আমার মত অনেক ব্যবসায়ী অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বিসমিল্লাহ ডোর এন্ড ফার্নিচারের মালিক মোঃ মানিক বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। ব্যবসায় লাভ তো দূরের কথা দোকান ভাড়া দিতে পারছি না। ড্রেন খোঁড়াখুড়ির কারণে এক বছর লসের উপর ছিলাম। এ সড়কের অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা ঘরে উঠে গেছে। কোন ব্যবসা নেই। সড়কের দুরাবস্থার কারণে কাস্টমারও আসতে চাই না। আমাদের সবার জোড়ালো দাবি দ্রুত যাতে কাজটি শেষ হয়।
মতিয়াখালী মসজিদের সামনের মেসার্স সাকিব এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মোঃ সাকিব বলেন, চলাচল এবং বাচ্চাকাচ্চাদের স্কুলে আনা নেওয়া চরম দুর্ভোগ হচ্ছে। আমরা যারা সড়কে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আছি আমাদের খুব বেহাল অবস্থা। গত তিন বছর থেকে আমাদের কোন ব্যবসা নেই। লসের উপর আছি। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে ব্যবসা করছি কিন্তু ইন্টারেস্ট দিতে পারতেছি না। আমাদের অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এ সড়কে বেশ কয়েকটি শিক্ষা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান আছে। ধূলাবালীর কারণে বাচ্চারা মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। গত তিন বছর ধরে আমরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। আমাদের দাবি দ্রুত কাজটা শেষ যাতে শেষ হয়।
লবণচোরা সুইচগেট ভাই ভাই ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপের স্বত্বাধিকারী মোঃ ওমর বলেন, গত তিন বছর থেকে ব্যবসার সবার একই অবস্থা। কাজ কাম নেই। সড়কের দূরাবস্থার কারণে গাড়ি আসতে পারে না, যার কারণে কোন কাজ নেই। ধূলাবালির কারণে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ বিরাজ করছে।
লবণচোরা বান্দা বাজারের এ বি ট্রেডার্স এর স্বত্বাধিকারী মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, ‘সত্যি বলতে কি আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত। সড়কের দূরাবস্থার কারণে আমরা ব্যবসায়ীরা সর্বশান্ত হয়ে গেছি।’
কাজে দীর্ঘসূত্রিতা সম্পর্কে সড়কটির সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বলছে, কাজের শুরুতে ওই সড়কের কাঠ ব্যবসায়ীদের কারণে ড্রেন করতে সময় ক্ষেপণ হয়েছে। এরপর প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমের কাজে বেশ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে। সড়কের কাজ শুরুর প্রায় দুই বছর পর ২০২৪ সালের জুন মাস থেকে ওয়াসা তাদের সুয়ারেজ লাইনের জন্য কাজ শুরু করে৷ আমাদের খোঁড়াখুড়ির কাজ শেষ হওয়ার পর পুনরায় তারা খোঁড়াখুড়ির শুরু করে। ওয়াসার কাজ চলমান থাকায় আমাদের কাজের ধীরগতি হচ্ছে। সড়কের সাবগ্রেট লেভেল থেকে কম্পেকশন করে প্রত্যেক লেয়ারে লেয়ারে বালু ফিলিং কম্পেকশন করা হয়। অতঃপর সাববেজ করা হয়। পরবর্তীতে ওয়াসা শুয়ারেজ লাইনের জন্য ৩০ ফুট গভীরতা করে মাটি খনন করে। খনন করার পর তাদের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার পর বালি ফিলিং এর কাজ শুরু করে। তারা কোন কম্পেকশন করে নাই। যেটা সড়কের জন্য হুমকি। পরবর্তীতে প্রত্যেকটা পিটের গোড়া দেবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।পরবর্তীতে এই অবস্থায় পিচের কাজ সম্পন্ন হলে সড়ক ডেবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু এর দায়ভার ওয়াসা নিতে রাজি নয়।
শিপইয়ার্ড সড়ক প্রশস্ত করণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের পিডি মোঃ আরমান হোসেন বলেন, ‘ওয়াসার কারণে কাজে দীর্ঘসূত্রিতা হচ্ছে। ওয়াসা পয়ঃনিষ্কাসনের কাজ শেষ করলে আমরা তিন মাসের মধ্যে কাজ শেষ করতে পারবো। মূলত ওয়াসার কারণে আমাদের কাজে হ্যাম্পার হচ্ছে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আছে তাদের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করতে হবে।’
খুলনা গেজেট/এনএম