ছোট হয়ে আসছে বিশ্বকাপ। একের পর এক তারকার পতন হচ্ছে। বিদায় নিচ্ছেন। তারকারা এখন পোস্টারবয়। এটাই হয়। তবে এবার কিছুটা ব্যতিক্রম। ট্রফি নেয়ার জন্য যারা কাতার এসেছিলেন তারা অনেকে নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। নতুন কোনো তারকার জন্ম হয়নি খুব একটা। তবে নতুন ফুটবলশক্তির উত্থান ঘটেছে। আর সেটা হচ্ছে মরক্কো।
আফ্রিকার কোনো দেশ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে কখনো খেলেনি।
এই টিমের কোনো নায়ক নেই। আছেন শুধু বেশ কয়েকজন দক্ষ ফুটবলার। এরমধ্যে আশরাফ হাকিমি অন্যতম। হাকিমি পিএসজিতে মেসি, এমবাপ্পে আর নেইমারের সতীর্থ। ফরাসি তারকা এমবাপ্পে টুইট করে এর আগেই তাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। ব্রাজিলিয়ান তারকা নেইমার বিদায় নিয়েছেন বিশ্বকাপের মাঝপথে। কোনো পাগলও ভাবেনি ক্রোয়েশিয়া ব্রাজিলের গতিকে থামিয়ে দেবে। বাস্তবে হয়েছে তাই। অঘটন যাকে বলে এটা তারই চূড়ান্ত পরিণতি। অনেকে বলেন, ব্রাজিল নেই বিশ্বকাপও নেই। এটা হয়তো পুরোপুরি সত্য নয়। কারণ ফুটবলদুনিয়া দু’ভাগে বিভক্ত।
একদিকে আর্জেন্টিনা, অন্যদিকে ব্রাজিল। মরক্কোর নব উত্থানে এক অবিশ্বাস্য জাগরণ তৈরি হয়েছে। এই বিজয় অবিস্মরণীয়, নাটকীয়। আরব দুনিয়ায় প্রথম বিশ্বকাপ। এই বিশ্বকাপে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। কিন্তু মরক্কো যেভাবে নিজেদের মেলে ধরেছে তা তুলনাহীন, অনুকরণীয়। শুধু টিম স্পিরিট দিয়ে একটি দল টোটাল ফুটবল খেলে রচনা করেছে নতুন ইতিহাস। পাল্লা দিচ্ছে সেন্ট্রাল আমেরিকা এবং ইউরোপের দলগুলোর সঙ্গে। কে জানে সামনে আর কী বিস্ময় অপেক্ষা করছে! ইউরোপের অন্যতম ফুটবলশক্তি পর্তুগালকে যেভাবে মরক্কো বিধ্বস্ত করেছে তা দেখে আরব দুনিয়ার নেতারা নিজেদের আনন্দ চাপা রাখতে পারেননি।
দুবাইয়ের ডেপুটি রুলার শেখ মাকতুম বিন মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম এক টুইটে এই বিজয়কে অপ্রত্যাশিত বিজয় বলে বর্ণনা করেছেন। বলেছেন, এটা আরব ফুটবলের জন্য এক নতুন বার্তা। এটা তাদের প্রাপ্য। টুইটারের মালিক ও টেসলার সহ-প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক টুইট করেছেন। বলেছেন, Congrats Morocco!!. আফ্রিকান ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট মেকি সাল এই বিজয়কে ঐতিহাসিক, ফ্যান্টাসটিক বলে অভিহিত করেছেন।
কলম্বিয়ার সুপারস্টার শাকিরাও মরক্কোকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এখানে বলে রাখি, আল থুমামা স্টেডিয়ামে ইতিহাস তৈরির পর মরক্কোনরা যেভাবে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন, আনন্দ করেছেন, রাস্তায় রাস্তায় গেয়েছেন, নৃত্য করেছেন- এমন কী আনন্দে কেঁদেছেন তা এই বিশ্বকাপের অন্যতম আকর্ষণ। আফ্রিকার ঘরে ঘরে এই আনন্দবার্তা পৌঁছে গেছে। এবার মরক্কো মুখোমুখি ফ্রান্সের। ফ্রান্স শনিবার রাতে বৃটিশ তারকা হ্যারি কেইনকে পরাস্ত করে কাপ নেয়ার তালিকায় এখন শীর্ষে। কেমন হবে মরক্কো-ফ্রান্সের লড়াই? একবাক্যে কেউ বলে দিতে পারছেন না। এমনকি ফরাসিরাও। ফরাসি সংবাদপত্রগুলো সে রকম ইঙ্গিতই দিচ্ছে।
তারা বলছে, যে কেউ জিততে পারে। হ্যারি কেইন পেনাল্টি মিস করে ইংলিশদের কাঁদিয়েছেন। ভেঙে দিয়েছেন তাদের স্বপ্ন। ’৬৬ সন থেকে তারা স্বপ্ন দেখছে কাপ নেয়ার। এবার কিছুটা স্বপ্নের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল। কিন্তু তারকারা পেনাল্টি মিস করবেন না তা কি হয়! যেমনটা লিওনেল মেসি প্রায়শই করে থাকেন।
যাই হোক, পেনাল্টি মিস না হলে হয়তো খেলার ভাগ্যে অন্যকিছু ঘটতে পারতো। যেতে পারতো শুট আউটে। কিন্তু যা হয়নি তা নিয়ে অঙ্ক মিলিয়ে কী লাভ! আল বাইত স্টেডিয়ামে ইংলিশদের আহাজারি ফুটবলের ইতিহাসে অন্যভাবে লেখা থাকবে। শেষ বাঁশি বাজার পর মনে হয়নি- অল্প সময় আগে এই স্টেডিয়ামে ফুটবল যুদ্ধ হয়ে গেছে। ইংলিশ ফ্যানদের অনেক বদনাম আছে। কিন্তু তারা নীরবেই মাঠ ছেড়েছেন। সঙ্গত কারণেই ফরাসিরা উল্লসিত। এই বিশ্বকাপ ঘুম কেড়ে নিয়েছে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। মরক্কোর সঙ্গে হেরে যাবার কারণে নয় কিন্তু। তিনি তার ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। যেভাবে পর্তুগিজ কোচ সাইডলাইনে বসিয়ে রেখেছেন তা ছিল রোনালদোর জীবনে এক কলঙ্কজনক অধ্যায়।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ছাড়ার পর রোনালদো বিশ্ব গণমাধ্যমের শিরোনামে উঠে আসেন। পর্তুগিজ কোচের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় তাকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখা হয়। খেলার শেষ দিকে তাকে মাঠে নামানো হলেও তিনি তখন ভগ্নহৃদয়ে ক্ষতবিক্ষত। ৩৭ বছর বয়সে তিনি বাজিমাত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সুযোগ পাননি নিজ দল থেকেই। ওদিকে রিয়াল মাদ্রিদের তারকা ক্রোয়েশিয়ার লুকা মদরিচ সমান বয়সী হয়েও আলোচনায় উঠে এসেছেন। মাঠে তাকে দেখে মনেই হয়নি তার বয়স হয়েছে।
তিনি এখনো উজ্জ্বল, শিক্ষকের ভূমিকায়। সতীর্থরা তার ব্যাপারে একাট্টা। গনসালো রামোস সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করে তাক লাগিয়ে দেন ফুটবলবিশ্বকে। রামোসই কাতার বিশ্বকাপের নতুন তারকার খ্যাতি পেয়েছেন। সবাই তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন। কিন্তু রোনালদো সতর্ক। তার জায়গাই দখল করেছে রামোস। রোনালদো এটা মেনে নিতে পারেননি। প্রকাশভঙ্গিতেও তা ফুটে উঠেছে। একজন তারকার এরকম পতন আর কোনো বিশ্বকাপ দেখেনি। নিজ দলের সমালোচনার মুখে তার বিদায় অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এক ঘটনা। বাকি থাকলেন দু’জন। লিওনেল মেসি আর কিলিয়ান এমবাপ্পে।
লড়াইটা কি তাহলে এই দু’জনের মধ্যেই হবে? মেসি পেছন থেকে এসে এমবাপ্পের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন। সৌদি আরবের কাছে হেরে যাবার পর অনেক বড় বড় পণ্ডিত আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন- এবার বোধকরি মেসির যাত্রাও থেমে যাবে। তবে মেসি থামেননি। দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছেন। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে লড়াইটা ছিল এই বিশ্বকাপের সেরা এক যুদ্ধ। যে কেউ জিততে পারতো। ভাগ্য বলে কথা। মেসি তার অগণিত ভক্তদের হতাশ করেননি। জিইয়ে রেখেছেন বিশ্বকাপের স্বপ্ন। লড়াইটা অবশ্য ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে। পুরনো হিসাবনিকাশ অমূলক প্রমাণ করে ক্রোয়েশিয়া এখন শেষ চারে। সেমিফাইনালে নাটকীয় কিছু ঘটলে হয়তো দুইয়ে চলে যাবে। রাশিয়া বিশ্বকাপেও রানার্সআপ হয়ে সামনে এসেছিল। আর ’৯৮ সনে হয়েছিল তৃতীয়। ফুটবল পণ্ডিতদের মতে, শেষ অব্দি আর্জেন্টিনাই যাবে ফাইনালে।
ফরাসিদের হাতে বিশ্বকাপ চার বছর ধরে। আরও চার বছর রাখার লড়াইয়ে তারা এখন মরিয়া। এমবাপ্পের বাহিনী যেভাবে ইংলিশদের বিধ্বস্ত করেছে তাতে অনেকেই বলছেন, কাপের ঠিকানা কি বদল হবে না! এমবাপ্পে তাই বলছেন, কাপ নিতে এসেছি। অন্যদের হাতে তুলে দিতে নয়। মাঠের বাইরের খেলায় আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু এই খেলা তো মাঠের খেলার ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারবে না। কারণ দুইয়ে-দুইয়ে চার। তিন-একে চারও হয়। ক্রোয়েশিয়া আর মরক্কোকে বাদ দিয়ে এই মুহূর্তে কোনো হিসাব যে মিলবে না।