খুলনা, বাংলাদেশ | ২২ পৌষ, ১৪৩১ | ৬ জানুয়ারি, ২০২৫

Breaking News

  ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে ২ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ৭০

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের পালে সুবাতাস

গেজেট ডেস্ক

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পরিবর্তিত রাজনৈতিক দৃশ্যপটে একটা সময় পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে অস্থিরতা বাড়তে থাকে। কিন্তু বর্তমানে এসে সেই পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে। পারস্পরিক আস্থা বাড়ানো ও স্থিতিশীলতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতি দুই প্রতিবেশীই আগ্রহ দেখিয়েছে। দুই দেশের সমৃদ্ধি ও সম্ভাবনা কাজে লাগাতে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতার ইচ্ছাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

ঢাকা-দিল্লির সম্পর্কের ইতিবাচক পরিবর্তনের হাওয়া আশাব্যঞ্জক মোড় নিচ্ছে। যদিও অনেকের শঙ্কা, বাংলাদেশে ভারত-বিরোধী মানসিকতা বেড়ে যাওয়ার কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি ঘটবে।

কিন্তু পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকসহ সাম্প্রতিক কূটনৈতিক আদান-প্রদান নতুন সম্পর্ক বোনার আভাস দিচ্ছে। পাশাপাশি বিরোধের জায়গাগুলো মীমাংসার ক্ষেত্রেও তারা ইতিবাচক।

১ জানুয়ারি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন স্পষ্ট করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও চীন- ২০২৫ সালে এই তিন বড় শক্তির সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। আর ঢাকার সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক কেবল একটি ইস্যুতে আটকে থাকবে না, বরং আরও বিস্তৃত হবে।

কিন্তু ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের বিষয়টির সুরাহা না হলে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক কীভাবে এগিয়ে যাবে, তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, অবশ্যই এটি একটি ইস্যু, আমাদের মধ্যে আরও অনেক দ্বিপাক্ষিক ইস্যু আছে।

‘আমি মনে করি, দুইপক্ষ যুগপৎভাবে সম্পর্ক এগিয়ে নেবে। পরস্পরিক স্বার্থগত অনেক ইস্যু রয়েছে। একে একে আমরা এসব ইস্যু নিয়ে কাজ করবো,’ বলেন উপদেষ্টা।

কাজেই কোনো একক ইস্যুতে আমাদের সম্পর্ক আটকে থাকবে না বলে জানিয়েছেন তৌহিদ হোসেন। শেখ হাসিনাকে প্রত্যার্পণের অনুরোধে ভারত সাড়া দেবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ। যদি ভারত থেকে কোনো জবাব না আসে, তাহলে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে দেশটিকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হতে পারে।

গেল ৩ জানুয়ারি ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আমরা একটি বার্তা পেয়েছি। সপ্তাহখানেক আগে বিষয়টি আমি আপনাদের নিশ্চিত করেছি। এই মুহূর্তে এর বাইরে আপনাদের কিছু বলতে পারছি না।

দুই দেশের মধ্যে আস্থা, সম্মান ও উদ্বেগ এবং স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে পারস্পরিক সংবেদনশীলতার ওপর ভিত্তি করে ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক নির্মাণে ইচ্ছার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরি। গেল ৯ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সফরকালে তিনি এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব আরও বলেন, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের মূল অংশীদার হলো দুদেশের জনগণ। বাণিজ্য, কানেক্টিভিটি ও অন্যান্য সক্ষমতা বৃদ্ধির খাতগুলোসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে উন্নয়ন সহযোগিতা ও বহুমুখী সম্পৃক্ততা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই করা হবে। এখন পর্যন্ত এটিই আমাদের অভিমুখ। এরইমধ্যে বেশকিছু বিষয়ে সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে।

ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরির ঢাকা সফরকালে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক লালনে নিজেদের অভিমুখের কথা জানিয়ে দিয়েছেন তারা। এতে গণতান্ত্রিক, স্থিতিশীল, শান্তিপূর্ণ, অগ্রসর ও অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে।

গেল ৩১ ডিসেম্বর ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনে যান বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা তাকে স্বাগত জানান।

এরপর ২ জানুয়ারি চট্টগ্রামের একটি আদালতে বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র ও পুণ্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর জামিন আবেদন নামঞ্জুর করার ঘটনায় নরম প্রতিক্রিয়া দেখায় ভারত। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলায় বর্তমানে তিনি কারাগারে আছেন।

‘গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা যাতে ন্যায়বিচার পান, এতটুকুই আমাদের প্রত্যাশা। আশা করি, বাংলাদেশ সেই ধরনের বিচারিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করবে,’ বলেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র।

এরইমধ্যে বাংলাদেশে আটক থাকা ৯৫ ভারতীয় মৎস্যজীবী ও নৌকর্মীকে তাদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। বিপরীতে একইভাবে ৯০ বাংলাদেশি মৎস্যজীবী ও নৌকর্মীকে নিজ দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে ভারত। আগামীকাল ৫ জানুয়ারির মধ্যে এই প্রক্রিয়া শেষ হবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এদিন আন্তর্জাতিক জলসীমায় বাংলাদেশি মৎস্যজীবী ও নৌকর্মীকে হস্তান্তর করার পর ৬ জানুয়ারি দুপুরে তারা চট্টগ্রামে পৌঁছাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এছাড়া ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদিও বাংলাদেশে আসছে। গেল ডিসেম্বরে ২৪ হাজার ৬৯০ মেট্রিক টন সিদ্ধ চালের একটি চালান ভারত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছেছে। ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রথম কোনো ভারতীয় পণ্যের চালান বাংলদেশে আসে।

ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে ইতিবাচক হাওয়া বইছে

পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকসহ সাম্প্রতিক কূটনৈতিক যোগাযোগ বলে দিচ্ছে, নতুন সম্পর্ক বিনির্মাণের পাশাপাশি বিরোধের জায়গাগুলো মিটিয়ে ফেলতে দুদেশই অঙ্গীকারাবদ্ধ।

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মরণে দুই দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ। দুই প্রতিবেশীর পারস্পরিক বিজয় দিবস উদযাপনে সামরিক ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা অংশ নেন। এই দ্বিপাক্ষিক সফরের কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় প্রবীণ যোদ্ধারা এক অনন্য বন্ধুত্ব উদযাপনের সুযোগ পান। পাশাপাশি তারা মুক্তিযুদ্ধের সময়কার স্মৃতিচারণও করতে পারেন। যা নিপীড়ন, গণহত্যা ও দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারত-বাংলাদেশের মিত্রবাহিনীর আত্মত্যাগকে প্রতীকায়িত করে।

এসব ঘটনাকে শেখ হাসিনার পতন ও তার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে যে প্রতিকূলতা তৈরি হয়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে যৌথ প্রচেষ্টা হিসেবেই দেখা হচ্ছে।

হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা বলেন, ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক নিয়ে আমি আশাবাদী। যদিও চারপাশে অনেক পরিবর্তনের ঘটনা ঘটছে। দুই দেশই পরস্পরের দিকে এমনভাবে এগিয়ে যেতে পারে, যাতে তাদের অন্য কোথাও যেতে না হয়।

‘পরস্পরের জন্য মঙ্গলজনক এমন দৃরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক ও স্থিতিশীল সম্পর্কের প্রত্যাশা করছে দিল্লি,’ বলেন তিনি। ‘কাজেই সম্পর্কের অবনতি ঘটছে, এমন ধারণাগুলো ঠিক না, সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আমরা কাজ করছি।’

পরবর্তী ফোনালাপে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বার্তা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পৌঁছে দেন হাইকমিশনার। আগামী ১৭ আগস্ট নয়াদিল্লিতে ভার্চ্যুয়ালি আয়োজিত দ্য থার্ড ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটে অংশ নিতে অধ্যাপক ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন মোদি।

জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের ফাঁকে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও তার বাংলাদেশি সমকক্ষ তৌহিদ হোসেনের মধ্যে বৈঠকের কথাও উল্লেখ করেন ভারতীয় এই কূটনীতিক। এছাড়া পরিস্থিতির যে অবনতি হচ্ছে না, তা নিয়ে আভাস দিতে সাম্প্রতিক অনুষ্ঠিত হওয়া পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ফরেন অফিস কনসাল্টেশনের কথাও বলেন তিনি।

প্রণয় ভার্মা বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ দৃঢ়তা আছে। এছাড়া ভারত থেকে বাংলাদেশে অপরিহার্য পণ্যও আসছে। এছাড়াও সম্ভবত অন্য দূতাবাসগুলো সবাই মিলে যা দিচ্ছে, তার চেয়েও বেশি ভিসা ইস্যু করছে ভারতীয় দূতাবাস।

নতুন নতুন অর্থনৈতিক সুবিধাদির জন্য ভৌগোলিক নৈকট্য কাজে লাগানোর প্রতি জোর দেন ভারতীয় হাইকমিশনার।

বিশ্লেষকরা বলেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ভবিষ্যত অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অনুঘটকের ওপর নির্ভর করছে। অর্থনৈতিক স্বার্থ, ভূ-রাজনৈতিক গতিশীলতা, জলবায়ু পরিবর্তন ও নিরাপত্তা উদ্বেগের মতো আসন্ন প্রতিকূলতাও সম্পর্কের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে দিতে পারে।- ইউএনবি

খুলনা গেজেট/এএজে




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!