কলকাতা মহানগরীর তালতলা এলাকার এক বিখ্যাত রাস্তার নাম আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। ৩৪ বছর ক্ষমতাসীন রাজ্য বামফ্রন্টের সদর দপ্তর বা বামফ্রন্টের বড় শরিক সিপি আই(এম)-এর রাজ্য অফিস এই বিখ্যাত রাস্তায় অবস্থিত। সাংবাদিক বা মিডিয়ার লোকজন সহ এই বিখ্যাত রাস্তাটি ২৪ ঘন্টাই জনবহুল। কলকাতার মৌলালি মোড় থেকে মল্লিকাবাজারের দিকে জোড়া গীর্জা বাসস্টপজের বিপরীতে ট্রামলাইন পেরিয়ে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের শুরু। পশ্চিম দিক বরাবর রাস্তাটি শেষ হচ্ছে নিউমার্কেট সংলগ্ন রফি আহমেদ কিদোয়াই রোডের কাছে গোলতলায়।
জনপ্রিয় এই রাস মাটির সুবাদে আলিমুদ্দিন জনপ্রিয় হলেও ব্যক্তি আলিমুদ্দিনের ইতিহাস কি আমরা জানি? কে এই আলিমুদ্দিন? কী তাঁর ইতিহাস? তা কি আমরা জানি? অথচ তিনি ছিলেন একজন ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী ও স্বাধীনতা স্বাধীনতা সংগ্রামী। মাত্র ৩৬ বছরে তাঁর জীবনদীপ নিভে গেলেও তাঁর বিপ্লবী কার্যকলাপ ব্রিটিশ সরকারকে তটরস্ত করে দিয়েছিল। আসুন আমরা তাঁর সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করি।
এই আলিমুদ্দিনের প্রকৃত নাম সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ। বাবার নাম সৈয়দ আমিরুদ্দিন আহমেদ। আলিমুদ্দিন আলিম মাস্টার নামে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। একসময়য় তিনি কিছু ছাত্রছাত্রী পড়াতেন। তাই তাকে সকলেই আলিম মাস্টার বলতেন। অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরের আকাশ জমাদার লেনে ১৮৮৪ সালে সৈয়দ আলিমুদ্দিন আহমেদ জন্ম গ্রহণ করেন। ঐতিহাসিক বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সতীর্থ ছিলেন আলিমুদ্দিন। মাদ্রাসার পাঠ শেষ করে ১৯০৬ সালে ভর্তি হন ঢাকা কলেজে। কিন্তু আর্থিক দুরবস্থার জন্য এফ এ পরীক্ষা দিতে পারেননি। মাঝপথে পড়া বন্ধ করে দিয়ে ঢাকা কালেক্টরিতে চাকরিতে যোগ দেন। আর চাকরি করাকালীন অবসর সময়ে কিছু ছাত্রছাত্রী পড়াতেন। আর এইসময় তিনি ‘মাস্টার সাহেব’ বা ‘আলিম মাস্টার’ হিসাবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন।
ছাত্রাবস্থায় আলিমুদ্দিন হয়ে ওঠেন বিপ্লবী মানসিকতার। ১৯০৫ সালে সুচতুর ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে ভাগ করার চক্রান্ত করে । সেই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলছে পুরোদমে। বিপ্লবী হেমচন্দ্ৰ ঘোষ প্রতিষ্ঠা করলেন এক গুপ্ত সমিতি। সেই গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেন আলিমুদ্দিন। এই গুপ্ত সমিতির একজন বলিষ্ঠ সদস্য হয়ে ওঠেন আলিমুদ্দিন। এখানে ব্রিটিশ বিরোধী সব ধরনের শারীরিক প্রশিক্ষণ হত আলিমুদ্দিনের নেতৃত্বেই। চলতো ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী কর্মকাণ্ড। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আলিমুদ্দিন গুপ্ত সমিতিতে মুষ্ঠি যুদ্ধ, কুস্তি, ক্যারাটে ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ দিতেন। আলিমুদ্দিন উপলব্ধি করেন যে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামই স্বাধীনতা অর্জনের প্রধান পথ। একের পর এক বিপ্লবীদের তিনি দক্ষ প্রশিক্ষণ দিতেন। বিপ্লবী কাজে অর্থ সংগ্রহের জন্য গোপনে গড়ে তোলেন ত্রাণ তহবিল। বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের যোগ্য শিষ্য হিসেবে বিপ্লবী আলিমুদ্দিন হয়ে উঠলেন ব্রিটিশদের কাছে এক ত্রাস। হেমচন্দ্ৰ সহ একের পর এক বিপ্লবীরা যখন জেলে, তখন বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অক্সিজেন যোগান আলিমুদ্দিন। আলিমুদ্দিনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সকলেই যোগ দিতেন । তিনি ছিলেন সমস্ত ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে। ‘মাস্টার সাহেব’ বা ‘আলিম মাস্টার’ ছদ্মবেশে তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড একটুও আন্দাজ করতে পারেনি ব্রিটিশ সরকার।
১৯২০সাল। মারাত্মক যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন আলিমুদ্দিন সাহেব। কিছু দিন রোগভোগের পর ১৯২০ সালে মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি মারা যান। এই তরতাজা বিপ্লবী আলিমুদ্দিন একদিন তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে ব্রিটিশদের চোখের ঘুম কেড়ে নেন। কলকাতার বিখ্যাত আলিমুদ্দিন স্ট্রিট তাঁর নাম বাঁচিয়ে রাখলেও তাঁর বিপ্লবী কর্মকাণ্ড আজ বিস্মৃতপ্রায়। ইতিহাস, আবার তুমি জেগে ওঠো।
খুলনা গেজেট/ টি আই