ডেঙ্গু মোকাবিলায় সরকারিভাবে যথাযোগ্য গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থতার দায় অনৈতিকভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জনগণের ওপর। আজ সোমবার (৩০ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ‘ডেঙ্গু সংকট প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়, যেখানে এসব তথ্য জানানো হয়।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে ডেঙ্গু প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসায় ঘাটতিসহ নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির কথা উঠে এসেছে। এডিস মশা ও ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সুশাসন নিশ্চিতে ২১ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো মো. জুলকার নাইন ও রিসার্চ ফেলো রাজিয়া সুলতানা।
টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে সারা বছরব্যাপী বিদ্যমান থাকলেও এই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক এবং সরকারিভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি। ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ও বিদ্যমান আইন অনুসরণ করা হয়নি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কর্তৃক সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনও অনুসরণ করা হয়নি। স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় নিজেদের মধ্যে সমন্বয় না করে যার যার মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
গবেষণার আওতাভুক্ত ১০টি জেলার মাঠ পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, সকল সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম এখনও শুধুমাত্র রাসায়নিক পদ্ধতির (লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড) মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় পাবলিক প্লেসে মশার প্রজনন স্থল ধ্বংস করা হলেও এখনও ঘরে ঘরে মশার প্রজনন স্থল চিহ্নিতকরণ ও ধ্বংস করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
মাঠ পর্যায় থেকে সংগৃহীত তথ্যের বিশ্লেষণে দেখা যায়, কোনো কোনো এলাকায় পাঁচ থেকে ২৭ বছর ধরে একই কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে। কীটতত্ত্ববিদ ও জনস্বাস্থ্য গবেষকদের মতে, একই কীটনাশক বহু বছর ধরে ব্যবহারের ফলে মশা কীটনাশক সহনশীল হয়ে যায়।
কোনো কোনো এলাকায় কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় না। আবার অনেক এলাকায় কীটনাশকের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হলেও সেখানে কীটতত্ত্ববিদ ও বিশেষজ্ঞদের কোনো সম্পৃক্ততা থাকে না। অন্যদিকে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ বিষয়ক স্বপ্রণোদিতভাবে তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।
গবেষণায় প্রতিবেদনে টিআইবি জানায়, ডেঙ্গু চিকিৎসা ব্যবস্থায় সক্ষমতার ঘাটতি ছিল প্রকট। ডেঙ্গুতে দেশে মোট মৃত্যুর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারা গেছে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিরা (১৯ শতাংশ)। এ ছাড়া আক্রান্তের সংখ্যা অনুপাতে ষাটোর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদের মৃত্যু হার অনেক বেশি। নারী ও বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সচেতনতা বৃদ্ধিবিষয়ক কার্যক্রম বা চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণে ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য সংকটকে কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা উঠে এসেছে গবেষণায়। মশা নিধনে দায়িত্বরত মাঠ কর্মীদের ১০০ থেকে ৫০০ টাকা দিলে বাড়িতে গিয়ে ‘অধিক কার্যকর’ ওষুধ দিয়ে আসার অভিযোগ যেমন পাওয়া যায়, তেমনই জিপির মাধ্যমে ওপেন টেন্ডারিং এর কিছু ক্ষেত্রে ‘সিঙ্গেল বিডিং’ এর প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়।
একটি কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওপেন টেন্ডারিং এর মাধ্যমে তিনটি সিটি করপোরেশনের ১৬টি ক্রয়াদেশ পায়। যার মধ্যে সাতটিতে একক বিডার হিসেবে টেন্ডারে অংশ নেয় প্রতিষ্ঠানটি। ডেঙ্গু আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও অনিয়ম ও দুর্নীতি পরিলক্ষিত হয়েছে। বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে ১০০ টাকার শিরায় দেওয়া স্যালাইন ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়েছে। আবার, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা অপ্রতুল ছিল।
খুলনা গেজেট/কেডি