গলায় ক্যামেরা আর পিঠে একটা ছোট্ট বাক প্যাক নিয়ে কৌস্তুভ ঘণ্টা খানেক অপেক্ষা করছে বাস স্টপে। বাসের দেখা নেই। আসার সময় হোটেলের গাড়ি এই পথেই যাচ্ছিল দেখে কৌস্তভ বেরিয়ে পড়েছিল কিছু না ভেবেই।
আসলে ভরা বর্ষা, তাতে এই কালিম্পং শহরে কাজের সুত্রেই আসা। উঠেছে সরকারি গেস্ট হাউস, ডেলোতে। সাধারণত এখানে প্রচুর পর্যটকের আনা গোনা লেগে থাকে। কিন্তু বর্ষায় সংখ্যাটা নগণ্য। সারা সপ্তাহটা কাজে ডুবে থাকে তাই অসুবিধা হয় না। মুশকিল হয় ছুটির দিন। আজ তাই চলে এসেছে চিত্রে জলপ্রপাত দেখতে। সত্যি দেখে মন ভরে উঠেছে কৌস্তভের। পান্না সবুজ গাছে ঢাকা পাহাড়ের গা ঘেঁসে নেমে এসেছে দুরন্ত ফেনিল জলের ধারা। বর্ষার ছোঁয়া পেয়ে সে পূর্ন যুবতী।
একটু একটু করে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলেছে।এবার একটু চিন্তায় পড়ল কৌস্তভ।
— “নাহ্ বড্ড দেরি হয়ে গেল, একে পাহাড়ে সন্ধ্যা নামে ঝপ করে তার ওপর যাওয়ার ব্যাবস্থা না জেনে চলে আসা ঠিক হয়নি। ফোনে নেটওয়ার্কও নেই যে হোটেলে ফোন করে গাড়ি ডেকে নেব।” নিজের মনে গজ গজ করছে কৌস্তভ।
পায়চারি করছে বেশ চিন্তিত হয়ে। ব্যাক প্যাকে যেটুকু জল ছিল এই এক ঘণ্টায় সবটাই খেয়ে ফেলেছে। স্বাভাবিক ভাবেই প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়া ছাড়া উপায় নেই। রাস্তা থেকে নেমে একটা মোটা গাছ। গাছটার মধ্যে কেমন অদ্ভুত গা ছমছমে ব্যাপার আছে। দেখলে মনে হয়গাছটা যেন একটা মানুষকে আঁকরে ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গাছের গায়ে একটা বড় গজাল পোঁতা। তাতেই ব্যাগটা ঝুলিয়ে কাজ সেরে নিল কৌস্তভ। ব্যাগটা নামাতে গিয়ে গজালটা ছিটকে কৌস্তভের বুকে এসে পড়ল। একটু ছড়েও গেল।
বাঁকের মুখে একটা গাড়ি দেখতে পেয়ে কৌস্তভ ছুটে রাস্তায় উঠে হাত নেড়ে থামালো।
গাড়ি চালাচ্ছেন পুলিশের উর্দি পড়া এক পাহাড়ি ভদ্রলোক।
—- স্যার একটু লিফ্ট দেবেন? এক ঘণ্টার ওপর দাঁড়িয়ে আছি কোনো বাস, ট্রেকার নেই। একটু যদি বড় বাস স্ট্যান্ড অবধি ছেড়ে দেন। প্লীজ দাজু (দাদা)।
—- আপনি বাঙ্গালী আছেন?
—হ্যাঁ
—-কুথায় যাবেন?
—ডেলো
—-উঠে আসুন। আমিও ওই দিকেই যাচ্ছি।
—-থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ।
গাড়িতে উঠে বসল কৌস্তভ, — ভাবিনি যে একটাও জীপ, বাস কিছু পাবো না
—- পাবেন কি করে মোর্চা যে বন্ধ ডেকেছে
—-সর্বনাশ। ভাগ্যিস আপনি এলেন। বাই দ্যা ওয়ে আমি কৌস্তভ।
—– দিলীপ থাপা, এস টি এফ। তা আপনি এখনে কি করছিলেন।?
—–চিত্রে ফলস্ দেখত এসেছিলাম, অনেক ছবি তুললাম। তবুও মন ভরল না।
—– আমি একটা জায়গা জানি যেখান থেকে আরো ভালো ভিউ পাবেন। দেখবেন নাকি?
লাফিয়ে উঠল কৌস্তভ।— অবশ্যই
—- আপনি ওই গাছটার কাছে কি করছিলেন?
—– ওই প্রকৃতির ডাক। বুঝলেন না…
—– হুম। না গেলেই পারতেন। কথিত আছে যে এই অঞ্চলে এক ডাইনির উৎপাত ছিল। সুন্দরী নারীর রূপ ধরে মানুষ খুন করতো। একতান্ত্রিক ওই গাছে সেই ডাইনিকে আটক করে রাখেন একটা গজালের মাধ্যমে। যতক্ষণ গাছে গজাল গোঁজা আছে, ডাইনি কারুর ক্ষতি করতে পারবে না।
—- এই রে, ডাইনি তাহলে মুক্ত!!! ব্যাগে লেগে গজালটা খুলে গেছিল । এই বলে কৌস্তুভ হো হো করে হেসে উঠল।
থাপা সাহেবের মুখে কিছুটা বিরক্তি ফুটে উঠেছে।
হটাৎ ভীষণ জোরে ব্রেক কষলেন থাপা সাহেব। সামনে একটি মেয়ে। রাস্তার মাঝ খানে দাঁড়িয়ে। সুন্দরী, আধুনিকা।এলো চুলে মুখটা অর্ধেক ঢাকা।
রেগে গাড়ি থেকে নেমে থাপা ওই মেয়েটিকে নিজের ভাষায় খুব বকা বকি করলেন, মেয়েটি মাথা নিচু করে শুনে কি উত্তর করল বুঝতে পারলো না কৌস্তভ। তারপর মেয়েটি ধীর পায়ে গাড়িতে উঠে বসল। অসম্ভব ফ্যাকাসে চেহারা। দৃষ্টিতে মৃত্যুর শীতলতা। গাড়ি জুড়ে কেমন যেন একটা ঠাণ্ডা ভাব।
—– স্যার ওকে তুললেন, যদি ডাইনি হয়, ভালো করে দেখে নিয়েছেন তো। নিজের রসিকতায় হো হো করে হেসে উঠল কৌস্তভ।
—– সে তো আমিও হতে পারি, গজাল খুলে যাওয়ার পরেই তো আপনাকে পিকআপ করলাম। ডাইনি নিশ্চই অন্যরূপও ধরতে পারে।
পিছন সিট থেকে উত্তর এলো,—-না, পারে না।
কিছুটা এগিয়ে একটা বাঁকে গাড়ি থামিয়ে থাপা সাহেব বললেন,
—- নেমে আসুন, এইদিক দিয়ে, আপনি এগিয়ে গিয়ে ছবি তুলুন, অমি একটু বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দি।
থাপা সাহেব দেখলেন ছেলেটি ছবি তুলছে। নির্জন তাই শাটার এর আওয়াজ আসছে। এমন সময় একটা মেসেজ ঢুকল। মোবাইল দেখে পাথরের মত দাঁড়িয়ে রইলেন। পিঠ আর শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যাচ্ছে, ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ও কপালে ফুটে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। একটি মেয়েলি হাতের ছোঁয়ায় সম্বিত ফিরল। শাটার এর আওয়াজ কানে আসছে না।
—– স্যার আপনাকে ক’জন খুঁজছে, কিছুটা দূরে নাকি একটা মৃত দেহ পাওয়া গেছে। আপনি কথা বলে নিন।
থাপা স্থির দৃষ্টিতে মোবাইলের দিকে তাকিয়ে, সেখানে ফুটে উঠেছে মৃত কৌস্তভের ছবি, সেই গাছের গোড়ায় শুয়ে। বুক এফোঁড় ওফোঁড় করে গেছে গজালটা।