প্রত্যাশিত পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরে তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। রাজনৈতিক মহল ও মিডিয়ায় এ নিয়ে এক সময় ঝড় ওঠে। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮নং খুটিতে প্রথম স্প্যান বসানোর মধ্যদিয়ে সেতু দৃশ্যমান হয়। এরপর একে একে ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটার দৈর্ঘ্যে ও ৪১টি স্প্যান বসিয়ে ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সেতু পুরোপুরি দৃশ্যমান হয় ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর।
জুন মাসে যানবাহন চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেওয়া হচ্ছে। সেতু দিয়ে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হলেও নিচের অংশ রেলের বড় একটি কাজ বাকি। সেতু নির্মাণে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা এ পর্যন্ত ব্যয় ধরা হয়েছে। এর মধ্যে জাপান সরকারের ঋণ মওকুফের তহবিলের অর্থ ৩০০ কোটি টাকা। এই অর্থ ফেরত দিতে হবে না। প্রায় ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা অর্থ মন্ত্রণালয়কে ফেরত দিতে হবে। এর সঙ্গে বাড়তি এক শতাংশ হারে সুদ ধরলেও পরিশোধ করতে হবে ৩৬ হাজার ৪০৩ কোটি টাকা। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হলেও এর ব্যয়ের অর্থ ঋণ হিসেবেই সেতু কর্তৃপক্ষকে দিচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পদ্মা সেতুর জন্য নেয়া ঋণ এক শতাংশ সুদসহ ৩৫ বছরে ফেরত দিতে হবে সেতু কর্তৃপক্ষকে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ি ২০২১-২০২২ অর্থ বছর থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করার উল্লেখ রয়েছে। সেতু প্রকল্পের কর্ম পরিকল্পনা অনুসারে আগামী ৩০ জুনের মধ্যে নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা। এর মধ্যে সেতু চালু হবে ধরে নিয়ে টোল আদায়কারী ও সেতু রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগ করেছে সেতু বিভাগ। এ কাজ পেয়েছে কোরিয়া এক্সপ্রেস কর্পোরেশন ও চায়না মেজর ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি। এর মধ্যে এমবিইসি বর্তমানে মূল সেতু নির্মাণ কাজ এবং কেইসি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে। আগামী ৫ বছরের জন্য এই দু’টি প্রতিষ্ঠান টোল আদায়, সেতু ও সেতুর দু’প্রান্তে যানবাহন চলাচল ব্যবস্থাপনায় আধুনিক পদ্ধতি চালু এবং সেতু ও নদী শাসনের কাজ রক্ষণাবেক্ষণ করবে। এর জন্য ৫ বছরে তাদের দিতে হবে ৬৯৩ কোটি টাকা।
এখন পদ্মা সেতু দিয়ে পার হতে ফেরিতে যানবাহন ভেদে ভাড়া দিতে হয় ৭০ টাকা থেকে ৩ হাজার ৯৫০ টাকা। প্রস্তাব অনুসারে সেতু পারে যানবাহন ভেদে টোল দিতে হবে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকা। মটর সাইকেল ফেরিতে ৭০ টাকা, সেতুর টোল হবে ১০০ টাকা, কার/জীপ ফেরিতে পারাপারে ৫০০ টাকা, সেতুর ওপর দিয়ে পার হতে টোল দিতে হবে ৭৫০ টাকা, পিকআপ ফেরিতে ৮০০ টাকা, সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ায় টোল ১৩০০ টাকা, ছোট বাস ফেরিতে ৯৫০ টাকা, সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ায় টোল ১৪০০ টাকা, মাঝারি বাস ১ হাজার ৩৫০ টাকা, সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়ায় টোল ২ হাজার টাকা, বড় বাস ১ হাজার ৫০০ টাকা ফেরিতে, সেতুর টোল ২ হাজার টাকা, বড় বাস ফেরিতে ১ হাজার ৫৮০ টাকা, সেতুর টোল ২ হাজার ৪০০ টাকা, ছোট ট্রাক ফেরিতে ১ হাজার ৮০ টাকা, সেতুর টোল ১ হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক ফেরিতে ১৪০০ টাকা, সেতুতে টোল ২১০০ টাকা, বড় ট্রাক ফেরিতে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা ও সেতুতে টোল ৫ হাজার ৫০০ টাকা (সূত্র প্রথম আলো, ২১ এপ্রিল-২০২২)।
সরকার প্রজ্ঞাপন জারী করেছে গত ১৭ মে। এ প্রজ্ঞাপনের মধ্যদিয়ে দক্ষিণ জনপদে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। জনগণের অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের পর মাত্রাতিরিক্ত টোল আদায় কোন মতেই দেশের বিদ্যমান আর্থসামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভয়ংকর মুদ্রাস্ফীতি, চাল-ডাল, পেঁয়াজ, ভোজ্যতেলসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামসগ্রীর মূল্য আকাশ ছোয়া, উর্দ্ধগতির পরিপ্রেক্ষিতে পদ্মাসেতু পারাপারের টোল জীবন যাত্রার ব্যয় ও পণ্য পরিবহণে ব্যয় বেড়ে যাবে। ঢাকা-খুলনা, ঢাকা-বাগেরহাট রুটে বাস ভাড়া বাড়তে পারে। এই ব্যয়ভার বহন করতে যেয়ে অনেককেই অনৈতিক পথ বেছে নিতে হবে। উচ্চ মাত্রার টোলের খেসারত দিতে হবে দেশের সব মানুষকে। টোল নির্ধারণে সরকারের এ সিদ্ধান্ত পুন: বিবেচনার দাবি রাখে।
খুলনা গেজেট/ এস আই