বাংলাদেশ দশম দেশ হিসেবে টেস্ট স্ট্যাটাস পেয়েছিল ২০০০ সালের ২৬ জুন। প্রায় পাঁচ মাস পর আসে ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ ও ঐতিহ্যগত ফরম্যাটে প্রথমবার খেলার সুযোগ। দিনটি ছিল ২০০০ সালের ১০ নভেম্বর। নাঈমুর রহমান, আমিনুল ইসলাম, শাহরিয়ার হোসেন ও হাবিবুল বাশার সুমনের হাত ধরে ওই দিন বাংলাদেশের ক্রিকেটে নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের বিপক্ষে ওই ম্যাচটি খেলে পেরিয়ে গেছে ২০টি বছর। টেস্ট মর্যাদা পাওয়া দেশের সংখ্যা বেড়ে এখন ১২টি। বয়সে তারুণ্য পেরিয়ে আরও দুই বছর পার করেছে, কিন্তু পরিপক্বতায় কতটা এগিয়েছে বাংলাদেশ!
এই দুই দশকে বাংলাদেশ খেলেছে ১১৯টি টেস্ট। জয় এসেছে মাত্র ১৪টি। হার ৮৯টি ম্যাচে এবং ড্র ১৬টিতে, যার বেশিরভাগই এসেছে বৈরি আবহাওয়ার কারণে। ২০ বছর আগে প্রথম ম্যাচে ৯ উইকেটের হার দিয়ে শুরু হয়েছিল বাংলাদেশের টেস্ট অধ্যায়। জিতেছিল চার বছর পর, ২০০৫ সালের ১০ জানুয়ারি জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। এরপর অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডের মতো পরাশক্তিকে হারানোর দারুণ সুখস্মৃতি রয়েছে তাদের, কিন্তু নবীন টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়া আফগানিস্তানের কাছে ঘরের মাঠে হেরে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন এখনও ভোলার নয়।
বাংলাদেশের দুই দশকের পথচলার প্রতিফলন দেখা গেছে র্যাংকিংয়েও, সেই ১০ নম্বরে। অথচ আগস্টের সর্বশেষ দলীয় র্যাংকিংয়ে তাদের পেছনে ফেলে নবম স্থানে উঠে গেছে আফগানিস্তান। এক কথায় সাদা পোশাকে বাংলাদেশের দুর্দশার চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে বেশি। এই লম্বা সময়ে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে টেস্ট ক্রিকেটকে। প্রতিষ্ঠিত দল হতে না পারলেও প্রতিপক্ষের কাছে সমীহ পাওয়া বাংলাদেশের অগ্রগতির ইঙ্গিত বহন করে। ২০১৭ সালে ১৯ মার্চ পি. সারা ওভালে নিজেদের শততম টেস্ট জিতে বিশ্বকে তারা নতুন করে জানান দিয়েছিল নিজেদের শক্তিমত্তার। আগের বছর ইংল্যান্ডকে ১০৮ রানে হারিয়ে বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। শততম টেস্ট জয়ের বছরে অস্ট্রেলিয়াকে নাকানিচুবানি খাওয়ানোর উল্লাসে মাতে তারা।
অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের মতো দলকে বধ করার ঘটনা ঘটলেও দক্ষিণ আফ্রিকা, পাকিস্তান, ভারত ও নিউ জিল্যান্ড অধরা থেকে গেছে। তাতে স্পষ্ট হয়ে গেছে, প্রত্যাশামতো অবস্থানে পৌঁছাতে পারেনি বাংলাদেশের টেস্ট। দেশে ধারাবাহিক কিছু জয় থাকলেও বিদেশে গিয়ে সামর্থ্যের পরিচয় তেমনটা দিতে পারেনি তারা।
যদিও টেস্ট অধ্যায়ে আমিনুল ইসলাম, হাবিবুল বাশার, খালেদ মাসুদ পাইলট, মোহাম্মদ রফিক, মোহাম্মদ আশরাফুল, সাকিব আল হাসান, মুশফিকুর রহিম ও তামিম ইকবালরা বিশ্ব ক্রিকেটে সুপরিচিতি পেয়েছেন। সাকিব, তামিম ও মুশফিক পেয়েছেন ডাবল সেঞ্চুরি। বল ও ব্যাট হাতে এখন বিশ্বের বাঘা বাঘা অলরাউন্ডারদের অনায়াসে টেক্কা দেন সাকিব। কিন্তু এই তারকাদের সাফল্য ম্লান হয়ে যায় দলীয় পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাবে।
বর্তমানে সাকিব, মুশফিক, তামিম ও মাহমুদউল্লাহর ওপর ভর করে চলছে দেশের ক্রিকেট। এক সময় বিদায় নিতে হবে তাদেরকেও। তখন যে শূন্যতা তৈরি হবে, তার জন্য কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ? ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামোগত দুর্বলতা, প্রথম শ্রেণিতে ক্রিকেটারদের অনাগ্রহ, ঘরোয়া ক্রিকেটে অপর্যাপ্ত পারিশ্রমিক, দল নির্বাচনে অদক্ষতা, পর্যাপ্ত সংখ্যক টেস্ট না খেলা- সব মিলিয়ে এসব বিষয় বাংলাদেশের টেস্ট সাফল্যের অন্যতম অন্তরায়।
ভারত-অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেট রঞ্জি ট্রফি ও শেফিল্ড শিল্ড থেকে উঠতি প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের দিকে যেভাবে নজর দেওয়া হয়, বাংলাদেশও একই পথে হেঁটে থাকে। কিন্তু ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেননি কেউ কিংবা তাদের দলে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ দেননি নির্বাচকরা। এই ২০ বছরে ৯৬ খেলোয়াড়ের অভিষেক হয়েছে টেস্ট দলে, যা ভুল নির্বাচনের আভাস দেয়।
তবে বাংলাদেশের টেস্ট অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা মনে করা হয় পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলার অভাব। যে কয়টি ম্যাচ তারা বছরে খেলে, সেখানে প্রতিপক্ষ হিসেবে থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের মতো দল। বিশ্বের পরাশক্তি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৫টি ম্যাচ খেললেও অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও ভারতের মতো দলগুলোর সঙ্গে নিয়মিত টেস্ট খেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করে। তা পূরণের সুযোগ করে দিয়েছে বিশ্ব টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড বাদে শীর্ষ পর্যায়ের অন্য দেশগুলোর সঙ্গে সূচি চূড়ান্ত হয়েছিল। ভারতের বিপক্ষে এই প্রতিযোগিতা শুরু করে হোয়াইটওয়াশড হয়েছে। পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ম্যাচের সিরিজের একটি টেস্ট খেলেই করোনার কারণে তা স্থগিত হয়েছে। মহামারিতে অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজও হয়েছে স্থগিত।
এই সিরিজগুলো হলেও হতে পারে। শোনা যাচ্ছে পয়েন্ট সমান ভাগে ভাগ করে দিতে চায় আইসিসি। তাহলে শূন্য পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের তলানিতে থাকা বাংলাদেশের কিছুটা উন্নতি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু এভাবে সৌভাগ্যের ছোঁয়ায় আর কতদিন? মর্যাদাপূর্ণ ফরম্যাটে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে হলে মনোনিবেশ করতে হবে উন্নতির পথ খোঁজায়। দূরদর্শী পরিকল্পনা করে গড়তে হবে শক্ত ভিত। যেন তিন দশক শেষে প্রস্ফূটিত হয় বাংলাদেশের অগ্রগতি, যুক্ত হয় বলার মতো কিছু সাফল্য!
খুলনা গেজেট/এএমআর