খুলনা, বাংলাদেশ | ২৭ আশ্বিন, ১৪৩১ | ১২ অক্টোবর, ২০২৪

Breaking News

  আজ মধ্যরাত থেকে ইলিশ ধরা-বিপণনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা
  ভারতে দুই ট্রেনের মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ, ১২ বগি লাইনচ্যুত

জোয়ার-ভাটার স্বপ্ন মরা কপোতাক্ষে

নিজস্ব প্রতিবেদক

আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। খুলনা মহানগর থেকে অন্তত ৬৫ কিলোমিটার দূরে পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী ও বাকারচর গ্রাম। এই পথ পাড়ি দিয়ে যেতেই দেখা মেলে মরা কপোতাক্ষ নদের খনন কাজ। সেখানে গোটা ২০ স্কেভেটর দিয়ে নদ খননের কাজ চলছে। খননের ফলে আবারও নদে জোয়ার-ভাটার স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। খননের ফলে অসংখ্য বাসিন্দা জমি-ঘর হারিয়েও খুশি।

প্রায় এক যুগ ধরে মরা কপোতাক্ষের প্রভাবে যেখানে তিন ফসলি হাজার হাজার বিঘা জমি হয়েছিল গলার ফাঁদ। বর্ষা মৌসুমে বাড়ি ছাড়তে হতো বাসিন্দাদের, এমনকি মৃত ব্যক্তির দাফন বা শেষকৃত্যেও দুর্ভোগে পড়তে হতো। এখন আর সেই দুর্ভোগ থাকবে না। সেখানে মরা কপোতাক্ষে এখন জোয়ার-ভাটার স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয়রা।

বাকারচরে দাঁড়িয়ে দেখা যায়, কপোতাক্ষ নদের এক পাশে খননের ফলে প্রাণ ফিরেছে। অন্যপাশে চলছে খননের কাজ। সেখানে দাঁড়িয়ে খনন কাজের দৃশ্য দেখছিলেন স্থানীয় অনেক বাসিন্দা। অনেকের ঘর, বাড়ি ও জমি এই খননে বিলীন হয়েছে। সব হারিয়েও এক পকার প্রশান্ত তাদের মনে। কারণ তারা কপোতাক্ষ নদে জোয়ার-ভাটার স্বপ্ন দেখছেন।

চরের বন্দোবস্ত জমিতে করা পাকা বাড়ি-ঘর, জমি ও স্থাপনা হারিয়েও তাদের আক্ষেপ নেই। তারা এখন দীর্ঘ জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তি ও তিন ফসলী জমি চাষ করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্পের (২য় পর্যায়) কাজ শুরু হওয়ায় টিকে থাকার নতুন এ আশা দেখছেন স্থানীয়রা।

জানা গেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মধ্য জুন, মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে ভিন্ন চিত্র খুলনার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী ও বাকারচর গ্রামে। এই এলাকার দুদিকে সাতক্ষীরা জেলার সীমানা, এক দিকে তালা উপজেলা, অন্যদিকে আশাশুনি। সেখানেই এক সময় দাপট দেখাত কপোতাক্ষ নদ। তবে ভরাটের ফলে ২০০৬ সাল থেকে ওই এলাকায় নদী তার অস্তিত হারাতে শুরু করে।

ধীরে ধীরে তা ভয়াবহ রূপ নেয়। আমন ও বোরো ধান তিন ধরনের ফসলের আবাদ হওয়া ২০ হাজার বিঘা জমি রূপ নেয় এক ফসলি জমিতে। এ অবস্থায় পানি উন্নয়ন বোর্ড যশোর ‘কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণ প্রকল্প (২য় পর্যায়) গ্রহণ করে। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট একনেক সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন লাভ করে।

প্রকল্পটিতে কপোতাক্ষ অববাহিকার জলাবদ্ধতা নিরসনকল্পে টিআরএমকে যুক্ত করে কপোতাক্ষ নদের উজান অংশে যশোর জেলার চৌগাছা উপজেলার তাহেরপুর হতে মনিরামপুর উপজেলার চাকলা ব্রিজ পর্যন্ত ৭৫ কিলোমিটার ও নীচের অংশে খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার বোয়ালিয়া হতে কয়রা উপজেলার আমাদী পর্যন্ত ৩০ কিলোমিটার নদী খনন, তীর প্রতিরক্ষা কাজ বাস্তবায়ন, নিষ্কাশন অবকাঠামো নির্মাণ ও মেরামত করা, কপোতাক্ষ নদের দুই তীরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ মেরামত করাসহ নদের সঙ্গে সংযুক্ত খাল খনন করা হবে।

সরকারি অর্থায়নে ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হওয়া প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। এতে ব্যয় হবে ৫৩১ কোটি ৭ লাখ টাকা। তাছাড়া এখানে পলি ব্যবস্থাপনা, টাইডাল প্রিজম বৃদ্ধি ও নিষ্কাশন ক্ষমতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ৩৫ বছর মেয়াদী জোয়ার-ভাটা নদী ব্যবস্থাপনা (টিআরএম) কার্যক্রম চালানোর উদ্যোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে স্কেভেটরের মাধ্যমে খনন চলছে মরা কপোতাক্ষে। সংশ্লিষ্টদের ধারণা ২০২৩ সালের মধ্যেই এখানকার কপোতাক্ষ আবার প্রাণ ফিরে পাবে।

সাতক্ষীরার আশাশুনির খরিয়াআঠি গ্রামের জিন্দা সরদার বলেন, এখানে কপোতাক্ষ নদ ছিল। পরবর্তীতে চর পড়ে ভরাট হয়ে যায়। তখন সরকার চিরস্থায়ীবন্দবস্ত জমি দিয়েছিল। নদী ভরাটের জমিতে আমি তিনটি পাকা ঘর তুলে বসবাস করতাম। আমি এখানে ৩০ বছর বসবাস করছি। দুটো দলিলে আমার ৬৬ শতক জমি ছিল। এখন আর নেই। অল্প কিছু থাকতেও পারে। তবে কতটুকু থাকবে বা থাকবে কিনা জানা নেই। তবে এই নদ খননে শুধু আমার নয়, সবার উপকার হচ্ছে। নদী না হলে ভবিষ্যতে সমস্যা হবে। তাই নদীটা হওয়া ভালো।

তিনি বলেন, নদী যখন ছিল না, বষার পানিতে জলাবদ্ধতার কারণে ডুবে থাকতে হতো। এখন আর সে দুর্ভোগে পড়তে হবে না। জমি হারিয়েও আমি খুশি। জনগণকে এই দুর্ভোগ আর পোহাতে হবে না।

স্থানীয় বাসিন্দা মো. সোহাগ সরদার বলেন, বাকারচরে এক বিঘা জমি কিনে ১৫ বছর আগে বসত শুরু করি। জীবনের আয়করা ২০-৩০ লাখ টাকা খরচ করে ছোটখাট পাকাঘর ৮টি স্থাপন করেছিলাম। নদ খননে ভাঙতে ভাঙতে ৭টি ঘর ভাঙা পড়েছে। এখন নদীর কূলে একখানা ঘর রয়েছে। সেটাতে অনেক কস্টে রয়েছি। জমি-ঘর গেলেও আমি খুশি। কারণ বৃষ্টিতে এই এলাকা তলিয়ে যেত। মাছ, ধানসহ সব ফসলাদী নষ্ট হয়ে যেতো। নদী হওয়াতে ব্যাপক উপকার হবে।

বাকা গ্রামের মো. হুমায়ুন আলী গাজী বলেন, এই নদে বড় বড় লঞ্চ, স্টিমার স্পিড বোট, নৌকা চলত। আস্ত আস্তে বুইজে (ভরাট) গেছে। জমি চাষ করতে পানি সরানোর জন্য ৪০-৫০ হাজার টাকা লাগত। এখন নদী খননে সবদিক থেকে উপকার হবে। নদী জীবন পেলে তা থেকে বাঁচতে পারব।

বাকারচর এলাকার আদিত্য ঘোষ, তপন ঘোষ, বেল্লাল হোসেন গাজী জানান, জলাবদ্ধতা কী কষ্ট তারা দীর্ঘদিন ধরে বুঝেছেন। এখন নদী খনন হলে আর পানি জমবে না। নদীর পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা যাবে। জেলেরা জাল-দড়ি নিয়ে নদীতে নামতে পারবেন।

ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার ইয়াকুব আলী জানান, গত জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু করেছেন। তার নিয়ন্ত্রণে চার কিলোমিটার খনন হবে। এতে প্রতিদিন দিনরাত ২০টি স্কেভেটর ব্যবহার করা হচ্ছে। খননের পর নদের গভীরতা হবে ১৩ ফুট, উপরিতলে প্রস্থ হবে ২৪২ ফুট। খনন কাজে স্থানীয়রা সহযোগীতা করছেন।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) যশোরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. তাওহীদুল ইসলাম বলেন, কপোতাক্ষ নদের জলাবদ্ধতা দূরীকরণের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পে ৭৯ কিলোমিটার খনন হবে। এটি বাস্তবায়ন হলে এখানকার মানুষ উপকৃত হবেন। কপোতাক্ষ প্রাণ ফিরে পাবে। দ্রুত গতি কাজ চলছে। ২০২৩ সালের মধ্যে খনন কাজ শেষ হবে।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!