সারাদিন ধরে কিসের যেন গন্ধ পাচ্ছি। ভীষণ চেনা একটা গন্ধ। কি যেন নাম? সেই থেকে অস্বস্তিটা চেপে বসেছে। ঠিক যেমন হয় কোথায় দেখেছি ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একটা চেনা মুখ যখন পাশ কাটিয়ে চলে যায়, অনেকটা তেমন অনুভূতি নিয়ে দিন কাটে।
এই তো সেদিন বাপের বাড়ির পাড়ায় হাঁটছি, এমন সময়, একটা দোকানের পাশ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে নাকে এলো কাঁচা রঙের গন্ধ, নিশ্চই কেউ কিছু রঙ করছিল কিন্তু আমি যেটা পেলাম সেটা হলো সেই ছোটবেলায় ফেলে আসা নড়বড়ে রথের গন্ধ। ভেসে এল একটা চ্যালা কাঠের একতলা কাঠামো, ভিতরে অধিষ্ঠিত ভাইবোন সহ জগন্নাথ, একটা পত্পতে পতাকা মাথায়, আর সামনে ঢেউ খেলানে বেড়ির ওপর ঘোড়া। ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যেতেই নাকে এল পাতা পচার গন্ধ। সঙ্গে সঙ্গে মনে এলো মেঘের জাফরি কাটা আকাশ আর অভিমানী বৃষ্টির গন্ধ। আরো দু’পা এগোতেই কানে এলো, অ্যাই মালাই বরফ। ব্যাস পটভূমি পালটে গেল। নাকে এল একটা গন্ধ, দুপুর বেলা ছোট মেয়েটা বিনুনি দুলিয়ে চেটে চেটে গুঁড়ো দুধ খাওয়ার গন্ধ। হঠাৎ বাড়িগুলো কেমন যেন জীবন্ত। কোন রোয়াকে তাস খেলার গন্ধ, কোন জানালার ফাঁকে আটকে আছে একটা সাইকেলের ক্রিং ক্রিং, কোন দেওয়ালে আবার আচার বড়ির গন্ধ। এইসব গন্ধের মাঝে কখন যেন ট্রেনে উঠে বসেছি খেয়াল নেই।
চোখে দেখা আর নাকে আসা ঘ্রানটার অস্তিত্বের পার্থক্য আমাকে চিরদিন দোটানায় ফেলেছে। দেখছি এক, ভাবছি এক, আর অনুভব করছি আর এক।
সেই দোটানার মধ্যেই মধ্যরাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম ছাদে, এটা আমার দক্ষিণের বারান্দা। সেই মিষ্টি গন্ধটা মম করছে চারিদিকে। এতক্ষনে বুঝলাম, আরে ওটা তো জোছনার ঘ্রাণ। চাঁদ তার মেঘের মত চুলের রাশি আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে মগ্ন, আর সেই মেঘের গা চুঁইয়ে নেমে এসেছে এই মম করা গন্ধটা। আবার একটা রিমঝিম শব্দ, কিন্তু তাতে বর্ষ শেষের বিদায়ী গন্ধ।
তাকিয়ে দেখি, মধুমালাতি গান ধরেছে, রাগ বাগেশ্রী। এই রাগের বিলম্বিত আলাপ ধ্যানমগ্নতার সৃষ্টি করেছে চরাচর জুড়ে। কাছের নারকেল গাছটায় থাকা রাতজাগা নাইটজারটি সেই শৃঙ্গার-রসাত্মক রাগের প্রকৃতিতে তাল মিলিয়েছে, ঠাট কাফি। হলুদ জোছনা মেখে ফুল পরী, নীল হওয়ায় ভেসে ঘুরে ঘুরে নেচে চলেছে। পায়ে তার বৃষ্টি নূপুর রিনিঝিনি বাজছে। সেই দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে কাঠ গোলাপ আর দোপাটি, বেলীফুলের গাছ গুলো মাথা দুলিয়ে তাল দিচ্ছে।
আমাকে দেখে কিছুটা যেন তাল কেটে ঘুরে তাকালো সেই ফুলপরী। সেই দৃষ্টিতে একটা অনুযোগের সুর। সত্যই তো, জলসায় আসতে বেশ দেরি হলো যে আমার। বিরক্ত ফুলপরী বিষাদের গন্ধ ছড়িয়ে মিশে গেলো হাওয়ার সঙ্গে। যেতে যেতে কবির কথায় ফিস ফিস করে বলে গেল, “জোস্নার গন্ধে ভরা রাতে আকাশের হলুদ ছায়ায় … আমি আজীবন খুঁজে যাব তোমাকে।”
আমার চোখ থেকে টুপ করে গড়িয়ে পড়ল দু ফোঁটা নীল যন্ত্রণা।
খুলনা গেজেট / আ হ আ