আজ ৮ই মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। বিশ্বব্যাপী নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা, তাঁদের কাজের প্রশংসা ও ভালোবাসা প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে নারীদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক সাফল্য অর্জনের উৎসব হিসেবেই পালন করা হয়। এবারের প্রতিপাদ্য ‘ডিজিটাল প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন, জেন্ডার বৈষম্য করবে নিরসন’। আধুনিক যুগে প্রযুক্তি খাত হচ্ছে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি খাত। নারীর ক্ষমতায়নে তথ্যপ্রযুক্তির গুরুত্ব অপরিসীম। বিশ্বায়নের এই যুগে কোনো দেশকে এগিয়ে নিতে নারীর ক্ষমতায়নের বিকল্প নেই। সেটা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একসময় ভেবেছিলেন ‘ঘরেই নারীর সিংহাসন। সেখানেই তাদের রাজত্ব, প্রকৃতিদত্ত কাজের স্থান’। তবে শিল্পায়ন, নাগরিক জীবন এবং শিক্ষা-স্বনির্ভরতা-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উন্মেষে নারীর জন্য ঘরের বাইরে কাজের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। ফলে দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রযুক্তিসহ প্রায় সকল ক্ষেত্রে নারীর বিচরণ চোখে পড়ে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকই নারী। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২০ সালের তথ্যানুযায়ী দেশের বর্তমান জনসংখ্যা ১৬,৫১,৫৮,৬১৬। এর মধ্যে পুরুষের সংখ্যা ৮,১৭,১২,৮২৪ জন এবং নারীর সংখ্যা ৮,৩৩,৪৭,২০৬ জন। দেশের সমগ্র নারী সমাজকে সাথে নিয়েই আমাদের উন্নয়নের পথে হাঁটতে হবে। অন্যান্য খাতের মতো তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও ইদানিং নারীর সম্পৃক্ততা বাড়ছে। ২০১৯ সালের আইএলও-এর তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৮ শতাংশ। সরকারি হিসাব মতে, কর্মক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রায় ১৫ শতাংশ নারী কাজ করেছে। প্রযুক্তিগত জ্ঞানের ব্যবহার নারীদের কর্মসংস্থানে ভূমিকা রাখছে, নারী উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে, দেশকে উন্নতির পথে এগিয়ে নিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তা নারী অধিকার রক্ষা ও ক্ষমতায়নেও সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দেশের উন্নয়ন মানেই ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের উন্নয়ন। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে আরো বেগবান এবং পুরুষের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে তথ্যপ্রযুক্তির অবদান রয়েছে। বিশ্বায়নের এ যুগে দেশকে এগিয়ে নিতে অন্যান্য খাতের পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নতি জরুরি। তথ্যপ্রযুক্তি খাত নারীর জন্য সম্ভাবনাময় হলেও বাংলাদেশে এ খাতে নারীর অংশগ্রহণ অনেক কম। বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ নারী শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে পড়াশোনা করছে। ্আর দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পেশাজীবীদের মধ্যে নারীর সংখ্যা মাত্র ১৩ শতাংশ। এক সমীক্ষা অনুুযায়ী, দেশে ৬২ শতাংশ মানুষের নিজের মোবাইল ফোন রয়েছে। পূরুষদের মধ্যে ৮৬ শতাংশের বেশি এবং ৬১ শতাংশের বেশি নারীর নিজস্ব মোবাইল ফোন আছে। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বৈষম্য ২৯ শতাংশ। নারীদের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারের মাত্রা ১৯ শতাংশ এবং পুরুষদের মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে প্রায় ১৩ শতাংশ কম নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ১৫-২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে মাত্র ১০ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে। শহরাঞ্চলে এই হার কিছুটা বেশি (২০ শতাংশ)। দেশে প্রযুক্তি ব্যবহারের মধ্যদিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও নতুন প্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতার বিকাশ ঘটছে। নব নব প্রযুক্তির আত্মীকরণ নারী উন্নয়নের পথকে তরান্বিত করে। তাই প্রযুক্তির সুফল জাতিগতভাবে পেতে হলে দেশের সব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের আগ্রহ, দক্ষতা ও এতে অভিগম্যতা থাকা জরুরি।
মূলত যা আমাদের উৎপাদনে সাহায্য করে, জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে যাবতীয় কর্মকা- সহজতর করে, যা যুগ ও পরিবেশ উপযোগী, তাকে প্রযুক্তি বলে। আর জেন্ডার হলো সমাজ আরোপিত একজন নারী ও পুরুষের পরিচয়। সমাজে নারী ও পুরুষ উভয়েই দৈনন্দিন কাজ করতে প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা ব্যবহার করে থাকেন। তবে বাংলাদেশে প্রযুক্তিনির্ভর হোক আর শারীরিক শ্রমে হোক, গার্হস্থ্য সামগ্রীর ব্যবহার ও পরিচর্যা নারীরাই করে থাকেন। ঘরের কাজে সময় ও শ্রম বাঁচানোর জন্য প্রযুক্তিনির্ভর নানা গার্হস্থ্য সামগ্রীর উদ্ভাবন হয়েছে। যেমন-ওয়াশিং মেশিন, ডিশ ওয়াশার, ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, ব্লেন্ডার মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন, টোস্টার, প্রেশার কুকার, রুটি মেকার, রাইস কুকার আরও কত-কী! উন্নত বিশ্বে নারী-পুরুষ উভয়ই এসবের সুবিধা ভোগ করে থাকেন। এদেশের পরিবারের গৃহপরিচারিকারা দিব্যি এসবের ব্যবহার শিখে নেন তবে পুরুষেরা সাধারণত এসব কাজে হাত দিতে চান না। অন্যদিকে প্রযুক্তিবান্ধব নারীকে দিয়ে পুরুষালি কাজ করিয়ে নিতে একটুও বাধে না। আবার অনেক পরিবারও প্রযুক্তি ব্যবহারে ছেলে ও মেয়ে সন্তানের মধ্যে বৈষম্য তৈরি করে থাকে। গ্রামে প্রযুক্তির ব্যবহার কম হলেও প্রযুক্তি বৈষম্য আরো বেশি।
ইউরোপ-আমেরিকায় রাস্তাঘাট, বাজার, অফিস-আদালত, পার্ক, সিনেমা, যানবাহন ইত্যাদি তৈরি করা হয় বৃদ্ধ, শিশু, গর্ভবতী, প্রতিবন্ধী ও অসুস্থ ব্যক্তিদের বিষয়টি মাথায় রেখে, যাতে তাদের চলাফেরা সহজসাধ্য হয়। বাংলাদেশে সে সবের আলামত কম দেখা যায়। জেন্ডার শব্দটি প্রয়োগ করলেই অনেকে ভাবেন, এতে কেবল নারীর অধিকারের কথা বলা হচ্ছে। আসলে জেন্ডার-সমতা নারী-পুরুষ উভয়ের সমানাধিকারে সোচ্চার। যে সমাজ নারীকে দ্বিতীয় লিঙ্গ বা অধস্তন বিবেচনা করে, সে সমাজের জন্যই জেন্ডার-সমতার প্রয়োজন। জেন্ডার ধারণা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে সব দেশেই কেবল পুরুষদের সুবিধার কথা পরিকল্পনা করে বিভিন্ন স্থাপনা, যানবাহন এমনকি পোশাকও প্রস্তুত করা হতো। প্রাকৃতিক দুর্যোগকবলিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে খোলা পায়খানা তৈরি করা হতো। মূলত জেন্ডার স্টাডি নারী-পুরুষের শারীরিক পার্থক্যকে মেনে নিয়ে সামাজিক পার্থক্য নিরসনের কথা বলে। নারীর শারীরিক গঠন ও চাহিদা পুরুষের থেকে ভিন্ন। তবে জেন্ডার বৈষম্য দূর করা মানে নারীর পুরুষ হয়ে ওঠা নয়।
সময়ের প্রয়োজনে পোশাকশিল্প কারখানায় লাখ লাখ নারীকে বিদ্যুচ্চালিত সেলাই মেশিনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ-এর মতে, ‘দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রেখেছে এদেশের তৈরি পোশাকশিল্প কারখানা, যেখানে ৯০ ভাগই নারী শ্রমিক। কিন্তু দুঃখের বিষয়, কারখানার যন্ত্রপাতির সবগুলোই নারীবান্ধব নয়।
প্রযুক্তি নিজের প্রয়োজনে এতটাই বুদ্ধিভিত্তিক যন্ত্রে পরিণত হচ্ছে যে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তা জেন্ডার-সমতা সঙ্গে নিয়েই আবির্ভূত হতে পারে। সুতরাং নারীকেও যদি উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে অপরিহার্য করে তুলতে হয়, তবে তাঁকে প্রযুক্তিবান্ধব করে তোলার জন্য জেন্ডারবান্ধব তথ্যপ্রযুক্তির বিকল্প নেই।
মূলত দেশে নারী-পুরুষের নানা অসমতার মধ্যে প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে। প্রযুক্তি নারী-পুরুষ সবার জন্য হতে হবে। সহজভাবে প্রযুক্তির ভাষা সাধারণ জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে দেশের একদম প্রান্তে থাকা একজন মেয়েকেও প্রযুক্তি নিয়ে পড়াশোনায় উদ্বুদ্ধ করা সম্ভব। নিরাপদ প্রযুক্তি ব্যবহার নিশ্চিত করতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়াতে হবে।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা ভাঙতে না পারলে প্রযুক্তি দিয়ে নারীকে এগিয়ে নেওয়া কঠিন। নি¤œবিত্ত ও নি¤œমধ্যবিত্ত নারীকে প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করতে হবে। সবাইকে প্রযুক্তির সুফলের এক ছাতার নিচে নিয়ে আসার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের পাশপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রযুক্তি নারীকে আর্থিক স্বাধীনতা দিচ্ছে। যেসব নারী বাইরে কাজ করতে গিয়ে পরিবারের বাধার মুখে পড়েন, তাঁরা প্রযুক্তির মাধ্যমে ঘরে বসেই আয় করতে পারছেন। অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে এখন অনেক নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছেন। তবে কোনো নারী পেশায় প্রবেশ করতে চাইলে প্রযুক্তির বিষয়ে তাঁর ভাসাভাসা জ্ঞান থাকলে চলবে না, অন্তত কয়েকটি বিষয়ে ভালো ধারণা থাকতে হবে। প্রযুক্তিভীতি প্রযুক্তি শিখতে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এই ভীতি কাটাতে বিদ্যালয় থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে শিশুদের পরিচিত করে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার মতো ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ থাকাকেও এখন মৌলিক অধিকারের মধ্যে ধরতে হবে। প্রযুক্তিকে হাতের নাগালে নিয়ে আসতে হবে, যেন সবাই তা ব্যবহার করতে পারেন। বাংলাদেশকে উদ্ভাবনের জায়গায় দেখতে চাইলে প্রযুক্তিতে মেয়েদের সুযোগ দিতে হবে। একটু প্ল্যাটফর্মের সুযোগ দিলে নারীরা অনেক বেশি ভূমিকা রাখতে পারেন।
বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে আগামীর কথা ভাবতে হবে। অগ্রজ প্রজন্ম পথ তৈরি করে দিচ্ছেন বলেই নতুন প্রজন্ম সেই পথে হাঁটতে পারছে। তিনি আরও বলেন, আজ যেটা প্রাসঙ্গিক, কাল সেটা অপ্রাসঙ্গিক। তাই প্রযুক্তির সঙ্গে দ্রুত খাপ-খাইয়ে নিতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তির মধ্যে থেকে নারীর নিরাপত্তাহীনতার দিকেও নজর রাখতে হবে। ফলে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। এ জন্য স্কুল পর্যায়ে কাজ শুরুর পাশাপাশি নারীদের অনলাইন নিরাপত্তার বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে। নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক দক্ষতা ও সামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ কাজের ক্ষেত্রে বৈষম্যও দূর করা প্রয়োজন। বর্তমান সরকার তথ্যপ্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। তবে সকারি উদ্যোগের পাশপাশি বেসরকারি উদ্যোগ, কর্মক্ষেত্রে নিরাপদ পরিবশে নিশ্চিতকরণ এবং সামাজিক ও পারিবারিক সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই।
লেখক : সমাজ গবেষক ও শিক্ষক, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।