এক টুকরো জমি বদলে দিয়েছে আব্দুল কাদেরের ভাগ্য। জমিটুকু জীবনের নিশ্চয়তা দেয়ার পাশাপাশি খুলে দিয়েছে আয়ের বহুমূখী পথ। এক সময়ে না খেয়ে থাকা আব্দুল কাদের পাড় (৪২) এখন ভূমিহীন মানুষের জন্য বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা। তিনি সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার ইন্দ্রনগর গ্রামের বাসিন্দা হলেও ২০০৪ সাল থেকে নলতা ইউনিয়নের বৈরাগীরচকে বসবাস শুরু করেন।
আব্দুল কাদের পাড় জানান, ৯ ভাই-বোন ও বাবা-মাকে নিয়ে ছিল তাদের সংসার। বাবা উত্তরাধিকার সূত্রে মাত্র ৩ শতক জমি পেয়েছিল। তিন বেলা খাবার কোনদিনই আমাদের জুটতো না। মা প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ভাতের মাড় এনে আমাদের খাওয়াতো। প্রচন্ড ক্ষুধা নিয়ে ভাইবোনেরা ভাগাভাগি করে আধা পেটা খেয়ে থাকতাম। লেখাপড়ার প্রতি আমার খুব আগ্রহ ছিল। বই, খাতা, কলম চেয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যেতাম। ছোটবেলা থেকেই দিনমজুরী করতাম। নিজের আয় থেকে কিছুটা লেখাপড়ার খরচ চালাতাম। খুব আশা ছিল, বিএ শেষ করার পর এমএ পড়বো। কিন্তু তা আর হলো না। বিএ (ফাজেল) পাস করার পর পরিবারকে সহায়তা করার জন্য একটি চাকরির খোঁজে ঢাকা গেলাম। তখন ১৫ হাজার টাকা ঘুষ হিসেবে দিলে একটি কোম্পানি চাকরি দিত। টাকা ছিল না, নিরুপায় হয়ে আবার গ্রামে ফিরে এলাম।
২০০১ সালে বাবা-মা বিয়ে দিয়ে আমার কাঁধে বোঝা তুলে দিল। থাকার জায়গা নেই, খাওয়ার কষ্ট। তখন বাবুরাবাদে উত্তরণ পরিচালিত একটি স্কুলে চাকরি নিলাম। সেখানে উত্তরণ কর্মকর্তাদের পরামর্শে এবং ভূমিহীন নেতাদের সহযোগিতায় বৈরাগিরচকে ভূমিদস্যুদের দখলীয় জমির মধ্যে আমি এক একর জায়গার দখল নিলাম। আমার মতো অনেকেই সেখানে বসবাস করতে শুরু করে। ভূমিদস্যুদের অব্যাহত হুমকি ও প্রতিনিয়ত চাপে মুচড়ে না পড়ে এক সময়ে জমির দলিল পাই। সে সময় অন্যের জমিতে কাজ করে যে টাকা পেতাম তা দিয়ে সংসার চালিয়ে নিজের দখলীয় জমিতে বাকি টাকার মাছ ছাড়ি। কোন রকমে দিন চলতে থাকে। দীর্ঘ ১৫ বছর অপেক্ষা আর লড়াইয়ের পর ২০১৯ সালে ১ একর জমি স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত পাই। জমির স্থায়ী দলিল তার জীবনের গতি পাল্টে দিতে শুরু করে। তৈরী করে বহুমূখী আয়ের পথ।
আব্দুল কাদের বলেন, জমির এক মাথায় বাড়ি তৈরী করে বসবাস করছি। বাকি জমিতে মাছ চাষ করি। মাছ থেকে প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা লাভ হয়। মাঝে মাঝে দিনমজুরীতে আয় হয় মাসে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা। হাঁস, মুরগি ও ছাগল বিক্রি করে বছরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হয়। এসব কাজে স্ত্রী তাকে সহায়তা করে। তবে উপার্জনের বেশিরভাগ টাকা ছেলেদের শিক্ষার পেছনে খরচ করতে হতো। বড় ছেলের পিছনে প্রতি বছর ৫০-৫৫ হাজার টাকা খরচ হতো। সে ঢাকাতে অনার্স পড়ার পাশাপাশি প্যাথলজিস্ট হিসাবে কাজ করে। বর্তমানে পড়াশোনার ব্যয় সে নিজেই চালাচ্ছে। ছোট ছেলের লেখাপড়ার পিছনে প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা খরচ হয়। বাঁশ, কাঠের বেড়া এবং আলবেস্টার শীট দিয়ে একটি ঘরও তৈরি করেছি। উত্তরণ থেকে অফেরতযোগ্য ৭ হাজার টাকা পেয়ে মাছ ছেড়েছিলাম। ক’দিন আগে তা ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। জমির কাগজ ব্যাংকে রেখে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ভাটা থেকে আগাম ইট কিনে রাখা হয়। ওই ইট বিক্রি করে ৭৫-৮০ হাজার টাকা লাভ হয়।
তিনি বলেন, জমির স্থায়ী দলিল আমাকে ব্যাংক ঋণ পেতে সহায়তা করেছে। আমার এখন সুখের দিন। তবে জীবনের শুরুর গল্পটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আমরা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দীর্ঘযাত্রা পেরিয়ে এসেছি।
কাদের বলেন, ‘২০১২ সালে আমি নিজের চেষ্টায় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করি। যার নামকরণ করা হয় “বৈরাগিরচক আহসানিয়া বেসরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়”। তিনি সেই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। তবে তিনিসহ কেউ বেতন-ভাতা পান না। স্কুলে ৬৫ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। আমি ওদের নিয়ে স্বপ্ন দেখছি।’
তিনি বলেন, শুন্য থেকে শুরু করেছিলাম। ২০/২২ বছর ধরে দেখছি উত্তরণ আমাদের পাশে ছিল এখনও আছে। আমাদের শূণ্য হাত পূর্ণ হয়েছে। আমরা উত্তরণকে ভালোবাসা ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি। তবে ভুমিহীন জনপদের দোয়া রয়েছে প্রতিষ্ঠানের পরিচালকসহ সকল কর্মীদের প্রতি।
এদিকে বৈরাগীরচকের ভূমিহীনদের জীবন জীবিকা এখন বৈচিত্র্যময়। বর্তমানে অনেকেই মাছ চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা করছে, কেউ পোল্ট্রি ফার্ম করেছে। অনেকেই ছাগল ও ভেঁড়া পালন করছে, কেউ কেউ মটর সাইকেল কিনে ভাড়ায় চালাচ্ছে। অনেকে চিংড়ি এবং সাদা মাছের পাশাপাশি কাঁকড়া চাষ করছে, কেউ ব্যবসাও করছে।
আব্দুর কাদেরের মতো ওই এলাকায় বসবাসকারী আশরাফুল ইসলাম, রহমত আলী, রমজান আলী, মোনতাজ আলী, মোঃ কুদ্দুস, সিরাজুল ইসলাম, ফরিদা পারভীনসহ অনেকের ভাগ্য বদলে গেছে।
খুলনা গেজেট/এসজেড