চুয়াডাঙ্গার জীবননগর ভূমি রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দলিল লেখক সমিতির অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও বেপরোয়া চাঁদাবাজি ব্যাপকহারে বৃদ্ধির অভিযোগ উঠেছে। সমিতির হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন জমির ক্রেতা-বিক্রেতারা। দলিল রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে সরকারি নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সমিতির নামে একটি নির্ধারিত হারে চাঁদা আদায় করছে। ভূমি রেজিস্ট্রেশনের যাবতীয় খরচের টাকা আদায়ও হচ্ছে সমিতির মাধ্যমে। সাধারণ দলিল লেখকরাও জিম্মি হয়ে পড়েছেন সমিতির নেতাদের কাছে। তারা সমিতির বাইরে গিয়ে কোনো ভূমি রেজিস্ট্রেশন করতে পারছেন না। রেজিস্ট্রি অফিসকে জিম্মি করে সরকারি নির্ধারিত ফিসের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে সমিতি। সাধারণ মানুষ অতিরিক্ত টাকা দিয়ে জমি রেজিস্ট্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।
আজ রোববার সরেজমিন গিয়ে জীবননগর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের সমিতির কাছে জমির দাতা ও গ্রহীতাদের জিম্মিদশার ভয়াবহ চিত্র পাওয়া গেছে। সমিতির বিনা অনুমতিতে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে কোনো জমি রেজিস্ট্রি হয় না বলে ব্যাপক অভিযোগ আছে। সাধারণ দলিল লেখকদেরও সমিতির বিনা অনুমতিতে দলিল করার সেই ক্ষমতা নেই। দলিল লেখার যাবতীয় টাকা দিতে হয় সমিতিকে। তারপর সমিতির গোপনীয় একটি সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহার করার পরই দলিল যায় সাব-রেজিস্ট্রারের টেবিলে। অফিসের বারান্দায় বসে একজন হিসাব রাখছেন কয়টি দলিল রেজিস্ট্রি হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, দলিল লেখক সমিতির সভাপতির কাছে ১ লাখ টাকার দলিল হলে ৩ হাজার ৫শ’ টাকা জমা দিতে হয়। পরে সেই টাকা ভাগ করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলিল লেখকেরা সমিতিসহ (দলিক লেখক সমিতি) জমির ক্রেতা ও বিক্রেতাদের জিম্মি করে আদায়কৃত টাকা ভাগ করে নিচ্ছেন সমিতির নেতারা থেকে শুরু করে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ও স্থানীয় প্রশাসনসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা। বিভিন্ন জায়গায় টাকা দিতে হয় বলে দলিল প্রতি অতিরিক্ত টাকা নেন।
জীবননগর উপজেলার বাঁকা গ্রামের জসিম উদ্দিনের(ছদ্মনাম) প্রথম স্ত্রী ২০২০ সালে মারা গেছেন। ২০২১ সালে তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। সম্প্রতি তিনি দ্বিতীয় স্ত্রীর সম্মতিতে তাঁর সন্তানদের কিছুজমি দান করার জন্য জীবননগর সাব–রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখকদের সঙ্গে কথা বলেন। সরকারি ওয়েবসাইটে জমি দানের জন্য হেবাদলিল বাবদ খরচ মাত্র ১ হাজার ১০ টাকা দেখানো হলেও তাঁর কাছে চাওয়া হয় ২২ হাজার টাকা।
এ বিষয়ে জসিম উদ্দিনের ছেলে মো. সেলিম (ছদ্মনাম) বলেন, ‘নিকট আত্মীয়দের জমি দান করতে হলে সরকারিভাবে খরচ হওয়ার কথা মাত্র ১ হাজার ১০ টাকা। এর মধ্যে রয়েছে এন ফি এবং এনএন ফি (নকলনবিশদের পারিশ্রমিক)। এক হাজার টাকার জায়গায় কীভাবে ২২ হাজার টাকা চাওয়া হয় আমি বুঝতে পারছি না।
জমি রেজিস্ট্রি করতে আসা কয়েক জনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের মধ্যে জীবননগর শাপলাকলিপাড়ার বাসিন্দা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী বলেন, চার কাঠা জমি কিনেছি ২ লাখ ৪ হাজার টাকায়। এ জন্য জমি রেজিস্ট্রি খরচ নেয়া হয়েছে ২৪ হাজার টাকা।
উথলী গ্রামের এক নারী জানান, তিনি ৮০ হাজার টাকায় ইউনিয়নের আওতাধীন জমি কিনেছেন। তার কাছ থেকে দলিল লেখকেরা খরচ বাবদ ৮ হাজার টাকা নিয়েছেন। আরও টাকা নেবে কী এ বিষয়ে তিনি জানেন না।
তথ্যনুসন্ধানে জানা গেছে ,জীবননগর দলিল লেখক সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম দীর্ঘ দিন যাবৎ সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে। সমিতির একটা অংশ নুরুল ইসলাম স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী নেতাদের মাঝে ভাগ করে দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে। সবাইকে ম্যানেজ করেই তিনি সমিতির কার্যক্রম চালাচ্ছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে জমি সরকারিভাবে খরচ হবে ১ লাখ টাকার দলিলে ৬ হাজার ৫শ’ টাকা এবং পৌরসভার ১ লাখ টাকার দলিলে ৭ হাজার ৫শ’ টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও সমিতির সভাপতি বিভিন্ন নেতাকর্মির নাম করে ইউনিয়নের জমি লাখে ১১ থেকে ১২ হাজার এবং পৌরসভার দলিলে লাখে
১২ থেকে ১৪ হাজার টাকা নিয়ে থাকেন ।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে জীবননগর সাব–রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল লেখক সমিতির সভাপতি মোঃ নুরুল ইসলাম বলেন, কোনো অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়না। পৌর এলাকায় জমি রেজিস্ট্রির জন্য এক লাখ টাকার দলিলের জন্য ৭ হাজার ৫০০ টাকা নেওয়া হয়। আর ইউনিয়নের জমি হলে লাখ প্রতি ৬ হাজার ৫০০ টাকা করে নেওয়া হয়। এর বাইরে আর কোনো টাকা নেওয়া হয়না।
অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জীবননগরের সাব–রেজিস্ট্রিার (অতিরিক্ত) এম নফিয বিন যামান বলেন, আমি এখন পর্যন্ত অতিরিক্ত টাকার নেওয়ার বিষয়ে কোনো লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেব। তিনি আরও বলেন, কেউ অতিরিক্ত টাকা চাইলে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। আমি ব্যবস্থা নেব। অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
জীবননগর উপজেলা নিবাহী অফিসার মোঃ আরিফুল ইসলাম বলেন, সরকার নিধার্রিত খরচের বাইরে কেউ অতিরিক্ত টাকা
নিলে প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
খুলনা গেজেট/ টি আই