খুলনা, বাংলাদেশ | ১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ১৬ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  খুলনায় মোটরসাইকেল ও ইজিবাইকের সংঘর্ষে নিহত ২
  ফ্যাসিবাদের শেকড় অনেক দূর ছড়িয়ে গেছে : আইন উপদেষ্টা

জাহাজসহ ২৩ নাবিক ফিরে পেতে কোন পথে এগোচ্ছে কবির গ্রুপ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশের পতাকাবাহী ‘এমভি আবদুল্লাহ’ নামের জাহাজটি দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন। ইতোমধ্যে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জিম্মি জাহাজের ২৩ নাবিকের পরিচয় জানা গেছে। বাঁচার আকুতি জানিয়ে গোপন অডিও বার্তা দিয়েছেন তাদের কেউ কেউ।

এর আগে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর ভারত মহাসাগরেই জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল একই কোম্পানির এমভি জাহানমণি নামের একটি জাহাজ। ওই জাহাজের ২৬ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল। ১০০ দিনের আন্তরিক প্রচেষ্টার পর তাদের মুক্ত করতে সফল হয় চট্টগ্রামভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি। এবারও পূর্বের সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরও দ্রুততম সময়ে ২৩ নাবিকসহ জাহাজ মুক্ত কারার পরিকল্পনা নিয়েছে শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ।

শিল্পগোষ্ঠীটির মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বুধবার (১৩ মার্চ) সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছেন, ঘটনার পর থেকে প্রথমে নাবিকদের সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে এগোচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি জানান, জলদস্যুরা নাবিকদের কোনো ক্ষতি করেনি। তারা সুস্থ আছেন। জাহাজে নাবিকদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, এটি নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। এমন জিম্মির ঘটনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঘটে থাকে। আমাদের অতীতে সফল অভিজ্ঞতা রয়েছে। আমরা আশা করছি, অতীতের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নাবিক ও জাহাজটি ফিরিয়ে আনতে পারবো। প্রয়োজনে মধ্যস্থতাকারী সংস্থা ও ব্রিটিশ বীমা কোম্পানির সহায়তা নেয়া হবে।

এদিকে, জাহাজের প্রধান কর্মকর্তা মো. আতিকউল্লাহ খান এক অডিও বার্তায় মঙ্গলবারই জাহাজটির মালিকপক্ষ কবির গ্রুপের কর্মকর্তাদের কাছে জাহাজে কী পরিমাণ খাবার ও পানি আছে এসব তথ্য জানিয়েছেন। জাহাজটি জলদস্যু নিয়ন্ত্রণে নেয়ার পর পরই তাদের এ বার্তা পাঠান তিনি।

জিম্মি জাহাজ ‘এমভি আব্দুল্লাহ’র দ্বিতীয় প্রকৌশলী খুলনার মো. তৌফিকুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন উৎকণ্ঠায়। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বিকেলে ঘটনা জানার পর থেকে দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের।

জিম্মি জাহাজটির প্রধান কর্মকর্তা (চিফ অফিসার) মো. আতিক উল্লাহ খান গতকাল মঙ্গলবার (১২ মার্চ) বাংলাদেশ সময় ইফতারের পরপর মুঠোফোনে তার স্ত্রীর কাছে একটি অডিও বার্তা পাঠিয়েছেন।

অডিও বার্তায় আতিক জানিয়েছেন, ‘এই বার্তাটা সবাইকে পৌঁছে দিয়ো। আমাদের সবার কাছ থেকে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়া হচ্ছে। ফাইনাল কথা হচ্ছে, তাদের (জলদস্যু) যদি টাকা (মুক্তিপণের অর্থ) না দেয়া হয়, তবে আমাদের একজন একজন করে মেরে ফেলতে বলা হয়েছে। তাদের যত তাড়াতাড়ি টাকা দেবে, তত তাড়াতাড়ি ছাড়বে বলেছে। এই বার্তাটা সবদিকে পৌঁছে দিয়ো।’

মঙ্গলবার রাতে চট্টগ্রামের নন্দনকাননে আতিক উল্লাহ খানের বাসায় গেলে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো তার বার্তাটি স্বজনেরা সাংবাদিকদের দেখিয়েছেন।

মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টার দিকে জলদস্যুরা জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। জাহাজটি মোজাম্বিক থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাচ্ছিল। জলদস্যুদের কবলে পড়া চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের এই জাহাজটি পরিচালনা করছে গ্রুপটির সহযোগী সংস্থা এস আর শিপিং লিমিটেড। জাহাজে আতিক উল্লাহসহ ২৩ বাংলাদেশি নাবিক রয়েছেন। তারা জিম্মি হওয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্ত উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় পার করছেন নাবিকদের স্বজনেরা।

আতিকের বাড়ি চন্দনাইশের বরকল এলাকায়। মা, স্ত্রী ও তিন মেয়েকে নিয়ে তিনি থাকেন শহরের নন্দনকানন এলাকায়। মা শাহানুর আকতার ছেলের চিন্তায় অস্থির। তিনি কখনো কাঁদছেন, কখনো-বা নামাজে দাঁড়িয়ে ছেলের জন্য দোয়া-দরুদ পড়ছেন।

শাহানুর বলেন, মাগরিবের সময় ছেলের সঙ্গে তার শেষ কথা হয়। তখন আতিক তাকে বলেছেন, তাদের ৫০ জন জলদস্যু ঘিরে রেখেছে। একটা কেবিনে বন্দী সবাই। তাদের সোমালিয়া নিয়ে যাচ্ছে। আড়াই দিনের মতো লাগবে ওখানে পৌঁছাতে। সবার জন্য দোয়া চেয়েছেন আতিক।

কথা বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শাহানুর। গতকাল বেলা আড়াইটার দিকে ছেলের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়ার কথা জানতে পারেন শাহানুর।

ভারত মহাসাগরে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই জলদস্যুরা সেটিকে সোমালিয়ার উপকূলের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। বর্তমানে জাহাজটি সোমালিয়ার বন্দরে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন জাহাজটির এক নাবিক।

এদিকে, পণ্যবাহী জাহাজটির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ। মঙ্গলবার (মার্চ ১২) দুপুর ১টার দিকে জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর জানতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠীটির কর্তৃপক্ষ।

আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে কয়লাবোঝাই জাহাজটির গন্তব্য ছিল সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইতে। ওই জাহাজের ক্রু লিস্ট থেকে জানা যায়, এম ভি আবদুল্লাহর মাস্টার বা ক্যাপ্টেন হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের রাশেদ মোহাম্মদ আব্দুর, চিফ অফিসার হিসেবে রয়েছেন চট্টগ্রামের খান মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ এবং সেকেন্ড অফিসার হিসেবে আছেন চট্টগ্রামের চৌধুরী মাজহারুল ইসলাম। সেই সঙ্গে থার্ড অফিসার হিসেবে রয়েছেন ফরিদপুরের ইসলাম মো. তারেকুল, ডেক ক্যাডেট হিসেবে আছেন টাঙ্গাইলের হোসাইন মো. সাব্বির।

বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুর ১২টার দিকে এমভি আবদুল্লাহ সোমালীয় জলদস্যুদের কবলে পড়ে। এরপর অন্তত ১০০ জলদস্যু জাহাজটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। বর্তমানে ২৩ নাবিককে কেবিনে রাখা হয়েছে। ঘটনাটি জানার পর নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে বলে জানান ওই শীর্ষ কর্মকর্তা। তবে যোগাযোগ না করেই কীভাবে নাবিকদের অবস্থা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছেন সে প্রশ্ন এড়িয়ে যান তিনি।

‘গোল্ডেন হক’ নামের জাহাজটি কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং করপোরেশনের বহরে যুক্ত হওয়ার পরে এর নাম হয় ‘এম ভি আবদুল্লাহ’। ২০১৬ সালে তৈরি ১৯০ মিটার লম্বা এই জাহাজটি গত বছর এসআর শিপিংয়ের বহরে যুক্ত হয়। এরপর সাধারণ পণ্য পরিবহন করে আসছিল জাহাজটি।

বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পগোষ্ঠী কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং ২০০৪ সালে তাদের প্রথম জাহাজ কেনে। ‘এমভি ফাতেমা জাহান’ ছিল তাদের প্রথম জাহাজ। দেশে এখন নিবন্ধিত সমুদ্রগামী জাহাজের সংখ্যা ৫২। এগুলোর মধ্যে ২৩টি কেএসআরএম গ্রুপের। আর এক দশকেই সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে জাহাজ পরিচালনা ব্যবসায় নেতৃত্ব দিচ্ছে গ্রুপটি। কবির গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের আরেকটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে কেএসআরএম।

এদিকে, ভারত মহাসাগরে কয়েক দশক ধরে বেশ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এ কারণে এ জলপথ ব্যবহার করে পরিচালিত পণ্য পরিবহন ব্যবসা হুমকির মুখে পড়েছে। তবে জলদস্যুদের কাছে বিষয়টি যতটা না ছিনতাই, তার চেয়ে বড় ধরনের আয়ের উৎস হিসেবে বিষয়টিকে দেখছে তারা। বিভিন্ন সময় দস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়া নাবিকেরা এমনটাই জানিয়েছে।

এর আগে, ২০১১ সালের মার্চে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয় বাংলাদেশি ২৬ নাবিকসহ বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি জাহান মনি। তিন মাস পর মুক্ত হয়ে জাহাজটি সোমালিয়া থেকে ওমানের সালালা বন্দরে যায়। একটি ছোট উড়োজাহাজে করে সোমালিয়ার জলদস্যুদের মুক্তিপণের টাকা পৌঁছে দেয়া হয়। মুক্তি পাওয়ার পর তা টেলিফোনে জানান জাহাজটির ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ।




আরও সংবাদ

খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!