যশোরের প্রধান ডাকঘরের দুর্নীতিবাজ পোস্টমাস্টার আব্দুল বাকীর বিরুদ্ধে এক কোটি ৭৮ লাখ পাঁচ হাজার টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পেয়েছে দুদক। এর আগে বিভাগীয় একাধিক তদন্ত কমিটির তদন্তেও তাকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শুধু বাকী না, এ টাকা হজমের সাথে তার দুই সহযোগীর নামও উঠে এসেছে দুদকের তদন্তে। মঙ্গলবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদক সমন্বিত যশোর জেলা কার্যালয়ের সাবেক সহকারী পরিচালক (বর্তমানে পদোন্নতি পেয়ে উপপরিচালক,বাগেরহাট) মোহা. মোশাররফ হোসেন সিনিয়র স্পেশাল জজ (জেলা ও দায়রা জজ) আদালতে এই চার্জশিট জমা দেন।
অভিযুক্ত অন্যরা হলেন, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানি উপজেলার খারঘাট উত্তরপাড়ার আক্কাশ সিকদার (বর্তমানে ডেপুটি পোস্টমাস্টার খুলনা কার্যালয়ে সংযুক্ত) ও সাব পোস্ট মাস্টার (নৈশ) যশোরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা ও মোবারককাটি গ্রামের মৃত শেখ আব্দুস সাত্তারের ছেলে শেখ করিমুল্লাহ। বাকীর সহযোগী হিসেবে তারা সাধারণ গ্রাহকের চোখে ধুলা দিয়ে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও পাস বই সংগ্রহ করে। পরে তা হারিয়ে যাওয়ার নাটক সাজিয়ে নানাভাবে প্রতারণা করে বিভিন্ন সময় এসব টাকা তুলে আত্মসাৎ করেন বলে দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের পিপি সিরাজুল ইসলাম।
অন্যদিকে, এ ঘটনায় আটকের পর থেকে এখনো পর্যন্ত জামিন পাননি তিনি। নিম্ন ও উচ্চ আদালতে একাধিকবার তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। দ্রুত এ মামলার বিচার কাজ শুরু হবে ও বাকি অন্য দু’অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হবে।
ডাক বিভাগ সূত্র, দুদকের মামলা ও তদন্তে সূত্রে জানা যায়, আব্দুল বাকী যশোর প্রধান ডাকঘরের পোস্টমাস্টার পদে থাকাকালীন ২০২২ সালের ২ জানুয়ারি থেকে ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সঞ্চয় ব্যাংকের ১৭ জন গ্রাহকের পাশবই ব্যবহার করে সরকারি এক কোটি ৭৮ লাখ ৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। গ্রাহকদের এসব অ্যাকউন্টে যৎসামন্য টাকা ছিলো। আব্দুল বাকী তাদের পাশবই নিজের কাছে রেখে ডাকঘরের নথিতে টাকা জমা দেখিয়ে এবং পরবর্তীতে গ্রাহকদের সই নকল করে সরকারি এক ১ কোটি ৭৮ লাখ ৫ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি শেখ মোহাম্মদ আলী নামে এক গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে সরকারি ১৩ লাখ টাকা উত্তোলনের সময় আব্দুল বাকী ধরা পড়েন। পরে ডেপুটি পোস্টমাস্টার মেহেরুন্নেছা লেজার যাচাই করে জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হন। বিষয়টি নজরে আসে গ্রামেরকাগজের। এ ঘটনায় গ্রামের কাগজে সংবাদ প্রকাশ হয়। নড়েচওে বসে ডাক বিভাগ। প্রাথমিক তদন্তে এসে সত্যতা পায়। এরপর ধারাবাহিক সংবাদ প্রকাশ হয় গ্রামের কাগজ ডিজাটাল ও প্রিন্ট ভার্সনে। একপর্যায়ে ১০ ফেব্রুয়ারি কোতোয়ালি থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের এবং অভিযুক্ত আব্দুল বাকীকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন ডাকঘরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এ ঘটনায় দফায় দফায় বিভাগীয় তদন্ত হয়। সেসব তদন্তে বাকীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়। এছাড়া,বিষয়টি দুদকের আওতায় পড়ায় দুদক যশোরের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মোহা. মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে মামলা করেন এবং তিনি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নিযুক্ত হন।
তাদের তদন্তে আরও উঠে আসে ওই টাকার মধ্যে যশোর ব্রাক ব্যাংকে ৬৩ হাজার ৬১৫ টাকা ও ৪০ লাখ টাকার এফডিআর রয়েছে। এছাড়া, যশোর প্রধান ডাকঘরে তার স্ত্রীর নামে দু’লাখ টাকা এফডিআর করা রয়েছে। যা আদালতের আদেশে জব্দ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, তদন্তে উঠে আসে আব্দুল বাকীকে সরকারি টাকা আত্মসাতে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন প্রধান ডাকঘরের সাবেক অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর মুদ্রাক্ষরিক আক্কাছ শিকদার ও নৈশ ডাকঘরের সাব পোস্টমাস্টার শেখ করিমুল্লাহ। এ চক্র যারা ২০০ থেকে ৫০০ টাকা জমা করে যশোর হেড পোস্ট অফিসে হিসাব বই খুলেছেন। এরপর আর সে বইয়ের খোঁজ রাখেননি। এমন সামন্য টাকা জমা দেয়ায় তারা আর ওই টাকা উঠাননি। আব্দুল বারী ওই হিসাব বই ও অফিসের লেজার বই সংগ্রহ করেন ওই দু’অভিযুক্তের মাধ্যমে। এরপর দু’বইতেই ইচ্ছেমতো টাকার অঙ্ক বসিয়ে রাখেন। কয়েকদিন পরই সেই টাকা কৌশলে উঠিয়ে নিতেন। টাকা উঠানোর সময় বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে তড়িঘড়ি করতেন এবং বলতেন এই গ্রাহকের জন্য বিভিন্ন মহল থেকে কল করছেন তাকে। এ সময় দায়িত্বরত কর্মকর্তারা হিসাব বই ও লেজার বই না দেখেই ওই টাকা আব্দুল বাকীর হাতে তুলে দিতেন। কিন্তু কেউই জমা সিডিউল দেখতেন না। তবে, ডেপুটি পোস্টমাস্টার মেহেরুন্নেছার কাছে চক্রটি ধরাশায়ী হন। বেরিয়ে আসে থলের বিড়াল।
খুলনা গেজেট/কেডি