অনেক নাটকীয়তা, দেনদরবারের পর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কাছ থেকে ২৬টি আসনে ছাড় পেয়েছিল জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জাপা)। সব মিলে এবার ২৬৫টি আসনে দলটির প্রার্থী ছিল। শেষ পর্যন্ত ছাড় পাওয়া ২৬ আসনের ১১টিতে জিততে পেরেছেন জাপার প্রার্থীরা। সমঝোতার বাইরে কোনো আসনে দলের প্রার্থী জিততে পারেননি।
ফলে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কমল। বর্তমানে দলটির ২৩ জন নির্বাচিত সংসদ সদস্য রয়েছেন। আর সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য রয়েছেন চারজন।
বেসরকারিভাবে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের, মহাসচিব মো. মুজিবুল হক, কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার জয়ী হয়েছেন। তাঁরা রংপুর, কিশোরগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালী থেকে নির্বাচন করেন।
এই চার জ্যেষ্ঠ নেতার বাইরে প্রেসিডিয়াম সদস্য মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী (ফেনী-৩), হাফিজ উদ্দিন আহমেদ (ঠাকুরগাঁও-৩), গোলাম কিবরিয়া (বরিশাল-৩), এ কে এম সেলিম ওসমান (নারায়ণগঞ্জ-৫), মো. আশরাফুজ্জামান (সাতক্ষীরা-২), এ কে এম মোস্তাফিজুর রহমান (কুড়িগ্রাম-১) ও শরিফুল ইসলাম (বগুড়া-২) নির্বাচিত হয়েছেন।
রুহুল আমিন হাওলাদার ও আশরাফুজ্জামান ছাড়া বাকিরা বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদেরও সদস্য।
একাদশ সংসদের ২৩ জন সদস্যের মধ্যে ঢাকায় সৈয়দ আবু হোসেন, গাইবান্ধায় শামীম হায়দার পাটোয়ারি, ময়মনসিংহে ফখরুল ইমাম, সুনামগঞ্জে পীর ফজলুর রহমান, কুড়িগ্রামে পনির উদ্দিন আহমেদ, নীলফামারীতে আহসান আদেলুর রহমান ও রানা মোহাম্মদ সোহেল, বগুড়ায় শরিফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জে লিয়াকত হোসেন, বরিশালে নাসরিন জাহান, বগুড়ায় নুরুল ইসলাম তালুকদারসহ ১৪ জন সংসদ সদস্য হতে পারেননি।
বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে জাপার প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ ও তাঁর ছেলে রাহগীর আল মাহি সাদ এরশাদ এবার নির্বাচন করেননি।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় আসন না পেয়ে কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।
এর বাইরে রংপুরে মসিউর রহমান রাঙ্গা ও পিরোজপুরে রুস্তম আলী ফরাজি দল থেকে বাদ পড়ে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করেছেন। তাঁরাও হেরেছেন।
রওশনপন্থী বলে পরিচিত রংপুর-১ আসনে মসিউর রহমান ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে জিয়াউল হক মৃধাকে জেতানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁরা জিততে পারেননি।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতায় এবার ঢাকায় একটি মাত্র আসন (ঢাকা-১৮) পায় জাপা। সেটি দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী ও প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরীফা কাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
রাজধানীর উত্তরা, খিলক্ষেত, তুরাগ, উত্তরখান ও দক্ষিণখান এলাকার এ আসনে শেরীফা কাদের জামানত হারিয়েছেন। তিনি হেরেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী খসরু চৌধুরীর কাছে। নিপা গ্রুপের চেয়ারম্যান খসরু চৌধুরী ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক।
২০১৪ ও ২০১৮ সালেও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে জাপা নির্বাচন করে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জাপাকে ৩৩টি আসন দেওয়া হয়েছিল। সেবার তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলেমিশে মন্ত্রিসভায় থাকে, আবার বিরোধী দলেরও ভূমিকা পালন করে।
২০১৮ সালের নির্বাচনে সমঝোতার মাধ্যমে জাপা ২৩টি আসন পেয়ে সংসদে বিরোধী দল হয়। এবার দলটি গতবারের অর্ধেকের কম আসন পেল।
এবার জাপা তাদের এযাবৎকালের সর্বোচ্চ ২৮৩টি আসনে প্রার্থী দিয়েছিল। এর মধ্যে ১১ জন প্রার্থী নিজে থেকে মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন। নির্বাচন কমিশনের যাচাই-বাছাইয়ের পর ২৬৫ জন প্রার্থী টিকে থাকেন। তবে নির্বাচনী প্রচার শুরুর পর থেকে ভোটের আগের দিন পর্যন্ত ১৯ জন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত ভোটে ছিলেন ২৪৬ জন। যদিও তাঁদের অনেকেই প্রচারে তেমন একটা ছিলেন না।
বর্তমান সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাপার অবস্থান আগামী সংসদে কী হবে, সে আলোচনা শুরু হয়েছে দলটির ভেতরে এবং রাজনৈতিক মহলে। কারণ, আওয়ামী লীগের নেতারা যাঁরা স্বতন্ত্র হয়েছেন, তাঁরা জাপার চেয়ে অনেক বেশি আসনে জিতেছেন।
গতকাল রোববার দুপুরে রংপুর-৩ আসনের ভোটকেন্দ্র পর্যবেক্ষণের সময় জাপার চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেন, ‘সব সময় আমাদের আশঙ্কা ছিল যে নির্বাচনে নিয়ে এসে আমাদের কোরবানি করা হবে। কোরবানি করে নির্ভেজাল, একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম করা হবে। এসব আশঙ্কা সত্যি হয় কি না, তা বিকেল হলেই বোঝা যাবে।’