জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খুলনা উপকূলীয় এলাকার প্রার্থীরা। তারা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকিতে খুলনা উপকূল। এ ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের যেই নির্বাচিত হন না কেন, তাঁরা এই অঞ্চলের পানি সংকট, লবণাক্ততা, বেড়িবাঁধ, নদী ভাঙ্গন ও জলাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করবেন।
খুলনা উপকূলের খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন সংসদীয় এলাকা ঘুরে প্রার্থী, ভোটার, পরিবেশ সংগঠক ও নাগরিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
খুলনার পাইকগাছার মাহমুদকাটি জেলেপল্লীর শংকর বিশ্বাস বলেন, উপকূল নিয়ে অনেক কথা হয়। কিন্তু কাজ হয় না। আগে ঝড়-ঝঞ্জা কম ছিল। আমাদের জেলেরা সাগরে মাছ ধরতে যেতেন। বড় ঝড়-ঝঞ্জার ভয় বেশী ছিল। কিন্তু এখন হঠাৎ হঠাৎ দুর্যোগ হচ্ছে। আমরা এই দুর্যোগ মোকাবেলায় এমপি প্রতিশ্রুতি চাই।
দাকোপের বানীশান্তা ইউনিয়নের আমতলা গ্রামের ঝর্ণা মন্ডল (৩৫) বলেন, দুর্যোগ এখন বলে-কয়ে আসে না। আমরা জনপ্রতিনিধিদের কাছে পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার, পানীয় জলের সংকট ও নদী ভাঙ্গন রোধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি চাই।
একই এলাকার শিলা রায় (৩৪) জানান, নির্বাচনের আগে প্রার্থীরা প্রতিশ্রুতি দেন, আমরা তার বাস্তবায়ন চাই।
সাতক্ষীরা শ্যামনগর আশরাফ কাগুজী (৫৮) বলেন, ‘আমরা সব সময়েই ভয়ে থাকি। কখন ঝড়, জলোচ্ছ্বাস আসে। বাঁধ ভাঙন, লবণাক্ততাসহ সমস্যার শেষ নেই। ভোটের আগে অনেকে কথা দেন, কিন্তু অবস্থা পাল্টে না। আমরা এ থেকে নিস্তার চাই।
বাগেরহাটের মোংলার সাংবাদিক আমীর হোসেন বলেন, ‘নির্বাচন এলে অনেক প্রতিশ্রুতি আছে। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি থেকে রেহাই নেই। শুধু প্রতিশ্রুতি নয়, আমরা কার্যকর উদ্যোগ চাই।’
খুলনা আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, ২০১১ সালে খুলনা অঞ্চলের গড়ে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ও সর্বনিম্ন ২১ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০১২ সালে সর্বোচ্চ ৩১ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ২০২০ সালে এই তাপমাত্রা দাঁড়ায় সর্বোচ্চ ৩১ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস, সর্বনিম্ন ২২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২১ সালের এপ্রিলে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা চলতি বছরে তা ৪১ দশমিক ৩ সেলসিয়াসে পৌঁছেছে। অবশ্য ১০ বছর পর গড় বৃষ্টিপাত কিছুটা কমেছে। ২০১৩ সালের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ছিল ১৭৩ মিলিমিটার। চলতি বছরে সেটি এসে দাঁড়িয়েছে ১৬৫ মিলিমিটার।
অপরদিকে বাংলাদেশে ২০০৭ সাল থেকে গেল ১০ বছরের সিডর আইলা, মহাসেন, রোয়ানু, মোরা, ফণি, বুলবুল, আম্ফান, ইয়াস, গুলাব, জাওয়াদ, সিত্রাং, মোখা, হামুন ও মিথিলী সহ ১৪টি শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। যার বেশীর ভাগেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাট উপকূলের মানুষ।
বর্তমান বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক উপমন্ত্রী ও বাগেরহাট-৩ আসনে প্রার্থী বেগম হাবিবুন নাহার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে উপকূলে লবণাক্ততা, পানি সংকট, ভূমিক্ষয়, নদী ভাঙন রয়েছে। অন্যান্য এলাকার থেকে এখানকার সমস্যাগুলো ব্যতিক্রম। নারী ও শিশু স্বাস্থ্য, কৃষি উৎপাদনে বিরূপ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। কিন্তু এসব বিষয়ে বরাদ্দ আশানুরূপ নয়। এসব ইস্যুতে সাধ্যমত কাজ করছি।
খুলনা-৬ (কয়রা-পাইকগাছা) আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. রশিদুজ্জামান বলেন, খুলনা উপকূলের মানুষের দুর্ভোগের শেষ নেই। বেড়িবাঁধ ভাঙন, লবণপানি ও নদী ভাঙন বন্ধ করা যাচ্ছে না।
এক সময়ে লবণপানির বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। এবার নির্বাচিত হলে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে এসব ইস্যু নিয়ে কাজ করতে চাই।
খুলনা-২ (সদর-সোনাডাঙ্গা) আসনে জাতীয় পার্টির প্রার্থী মো. গাউসুল আজম জলবায়ূ পরিবর্তনে মোকাবেলায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেন, নির্বাচনে হলে ঝুঁকি মোকাবেলায় কাজ করবো।
একই আসনে বাংলাদেশ কংগ্রেসের প্রার্থী দেবদাস সরকার তিনি দুর্যোগ কবলিত কয়রার মানুষ পরিচয় দিয়ে বলেন, উপকূলের মানুষ দুর্যোগে বিপর্যস্ত। এতে থেকে উত্তরণে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
সাতক্ষীরা-৪ আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী আতাউল হক দোলন বলেন, নির্বাচিত হলে-প্রথম কাজ হবে চলমান বেড়িবাঁধ কাজ দ্রুত শেষ করা। সাইক্লোন সেন্টার স্থাপন, মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন ও উপকূলীয় মানুষের কর্মসংস্থানে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা হবে।
একই আসনে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) প্রার্থী গোলাম রেজা বলেন, শ্যামনগরের গাবুরা-গড়াইখালীর দুরাবস্থা কারো অজানা নয়। আমি নির্বাচনে হলে তাদের জন্য কাজ করতে চাই।
সাতক্ষীরার মানবাধিকার সংগঠন স্বদেশ’র নির্বাহী পরিচালক মাধব চন্দ্র দত্ত উপকূলের দুর্ভোগ মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দাবি করেন। তিনি বলেন, সংসদ সদস্য প্রার্থীরা যে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন; সেগুলো তাদের রক্ষা করা উচিত। না হলে উপকূলবাসীর টিকে থাকা অসম্ভব হবে।
তৃতীয় উপকূলীয় পানি সম্মেলন কমিটির সাধারণ সম্পাদক শামীম আরফীন বলেন, ‘সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত উপকূলকে রক্ষা করা যাবে না। আগামীদিনে নীতি নির্ধারকদের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই প্রশংসনীয়। ভূ-প্রকৃতিগতভাবে ভিন্ন আবহের খুলনা উপকূলের জন্য বিশেষ উদ্যোগ জরুরি। না হলে আর্থসামাজিক সকল ক্ষেত্রে দেশের অন্যতম বৃহৎ অংশটি পিছিয়ে পড়বে।’
খুলনা গেজেট/এনএম