খুলনা, বাংলাদেশ | ৬ অগ্রহায়ণ, ১৪৩১ | ২১ নভেম্বর, ২০২৪

Breaking News

  ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে করা ৬ মামলা বাতিল করেছে হাইকোর্ট
  জুলাই-আগস্টে হত্যা : সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি মেহেদীর জামিন স্থগিত
  সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষ্যে শিখা অনির্বাণে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা

জয়তু খুলনা গেজেট

মোহাম্মদ মাজহারুল হান্নান

প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানব সভ্যতার অগ্রযাত্রার সাথে সাথে মানুষের জানবার আকাঙ্খা সৃষ্টি হল এবং ক্রমান্বয়ে মানুষের তথ্য অনুসন্ধিৎসা বাড়তে থাকল। আবার একথাও ঠিক যে, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির নতুন নতুন সব আবিষ্কারের ফলে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম মানুষের তথ্য তৃষ্ণা মিটানোর প্রয়াস পেল। আমরা জানি যে, মুদ্রাযন্ত্রের প্রচলনের ফলে সংবাদ পত্রের উদ্ভব হল। আবার সাম্প্রতিককালে বৈদ্যুতিক প্রকরণের মাধ্যমে তথ্য প্রবাহে যে মহাবিপ্লব ঘটেছে তাতে দুরদৃষ্টিসম্পন্ন মনীষী কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্বপ্নের বাণী- “বিশ্বজগৎ দেখব আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে” বাস্তবে রূপ নিল। তাইতো আজ মানুষ মুহুর্তের মধ্যে পৃথিবী নামক এই গ্রহের, তথা সমগ্র সৌরজগতের কোথায় কি ঘটছে তার সব কিছু জানতে, শুনতে ও দেখতে সক্ষম হয়েছে।

একটি স্বাধীন দেশের প্রকৃত স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের শুদ্ধ চর্চার পূর্বশর্ত হল সংবাদপত্র তথা সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা। অথচ বাস্তবতা হল যে, বিশ্বের কি উন্নত, আর কি উন্নয়নশীল বা অনুন্নত প্রায় প্রতিটি দেশেই সংবাদপত্র প্রকাশনার উষালগ্ন থেকেই সরকারের সঙ্গে সংবাদপত্র সেবীদের দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠে। তাই’ত দেশে দেশে শাসকবর্গ সংবাদপত্র প্রকাশনাকে সাধারণত সুনজরে দেখে না। একথা খুবই সত্য যে মুক্ত ও স্বাধীন সংবাদপত্র গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার কথা বললেও যুগে যুগে, দেশে দেশে শাসকবর্গ সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে হরণ করতে তৎপর হয়। আবার অনেক ক্ষেত্রে শাসকবর্গ তাদের অপশাসনকে বৈধতা দিতে বা নিজেদের হীন স্বার্থ হাসিলের জন্যে ছলে বলে কৌশলে সংবাদপত্রসহ অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করতে দ্বিধা করে না।

বিশ্বে সর্বপ্রথম মুদ্রিত আকারে কখন এবং কোথা হতে সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছিল তা বেশ কিছুটা অস্পষ্ট থাকলেও এই কথা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় যে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী জেমস্ অগাস্টাস হিকি কিছুটা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেই কোলকাতা হতে সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং ১৭৮০ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি তিনি ব্রিটিশ ভারতে প্রথম সংবাদপত্র ”The Bengal Gazette” প্রকাশ করেন। তাই’ত অগাস্টাস হিকিকে অবিভক্ত ভারতে সংবাদপত্রের জনক বলা হয়।

এরপর পর্যায়ক্রমে বেশ কয়েকটি ইংরেজী পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। বাঙ্গালীর নব জাগরণের অন্যতম পুরোধা রামমোহন রায় ছিলেন উদার ও প্রগতিশীল চিন্তার জাগ্রত মনের অধিকারী এক মানুষ। তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের সামাজিক কুসংস্কার ও অনাচার দুরীকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের জন্যে সংবাদপত্র প্রকাশনায় আত্মনিয়োগ করেন। রামমোহন রায় ১৮২১ খ্রীস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ব্রাহ্মণ সেবধি’ ও ‘সংবাদ কৌমুদী’ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হন। এছাড়াও তিনি ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ফার্সি ভাষায় মিরাৎ-উল-আখবার নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন যা পরের বছরই সাংবাদপত্র নিয়ন্ত্রণ বিধির কারণে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এর আগে শ্রীরামপুর মিশন-এর জন ক্লার্ক মার্শম্যানের সম্পাদনায় ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিলে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাময়িক পত্র ‘মাসিক দিগদর্শন’।

ঐবছরের ২৩ মে মার্শম্যানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষায় প্রথম সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। তবে এর সম্পাদনার কাজে সহায়তা করেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার, তারিণী চরণ শিরোমণি প্রমুখ। সমাচার দর্পণ শিক্ষিত বাঙালির মধ্যে নতুন প্রাণস্পন্দন নিয়ে আসে।

এরপর ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দেই গঙ্গা কিশোর ভট্টাচর্যের প্রকাশনা ও হরচন্দ্র রায়ের সম্পাদনায় কলকাতা থেকে বাঙালী পরিচালিত প্রথম সাপ্তাহিক ‘বঙ্গাল গেজেট’। পর্যায়ক্রমে আরও সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।

এরপর বাংলার মুসলিম সমাজের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক পশ্চাদপদতা দূর করার লক্ষ্যে সমকালীন মুসলিম চিন্তাবিদ, লেখক, সমাজসেবী মুসলিম বাংলার সাংবাদিকতার জনক মাওলানা আকরাম খাঁ এগিয়ে এলেন সংবাদপত্রের জগতে। শুরু হল বাংলার সংবাদপত্রের অঙ্গনে মুসলিম চিন্তাবিদ, লেখক, সাহিত্যিক ও সাংবাদিকদের যাত্রা। বাংলার মুসলমানদের দ্বারা প্রকাশিত অর্ধ-সাপ্তাহিক ‘মোহাম্মদী আখবার’। এটি কাজী আব্দুল খালেকের সম্পাদনায় ২৪ পরগনার শিয়ালদহ থেকে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত বাংলা ও উর্দ্দু দ্বিভাষিক পত্রিকা এবং পরের বছর হতে সাপ্তাহিক পত্রিকা রূপে প্রকাশিত হতে থাকে। এরপর ধারাবাহিক ভাবে মুসলমান সাহিত্যিক সাংবাকিদের উদ্যোগে আরও সংবাদপত্র ও পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে।

পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) ভূখন্ডে প্রথম সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘রংপুর বার্তাবহ’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালীচন্দ্র রায়। ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে (১২৫৪ বঙ্গাব্দ) গুরুচরণ শর্মার সম্পাদনায় রংপুর হতে এই পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে এক সরকারী আদেশে ‘রংপুর বার্তাবহ’ পত্রিকাটি বিলুপ্ত করা হয়। পূর্ববঙ্গে প্রথম ইংরেজী সংবাদপত্র ‘ঢাকা নিউজ’ ১৮৫৬ খ্রিঃ ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৪৭-এ ব্রিটিশ বিদায় নিল এবং ভারত বিভক্ত হল। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে মাওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা কলকাতা হতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ববাংলা) রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর করে প্রকাশিত হল। এরপর ঢাকায় প্রকাশিত হল দৈনিক সংবাদ (১৯৫১ খ্রি:), দৈনিক ইত্তেফাক (১৯৫৩ খ্রিঃ)। পরবর্তীকালে প্রকাশিত হতে থাকে অন্যান্য বাংলা ও ইংরেজী দৈনিক, সাপ্তাহিক ও সামায়িক পত্রিকা। এসব পত্রিকাগুলির মধ্যে যেমন জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকা রয়েছে তেমনই আছে আঞ্চলিক পর্যায়ের পত্রিকা। ঢাকার বাইরে অন্যান্য মফস্বল শহরের মত ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে অবিভক্ত ভারতের খুলনাতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মুদ্রিত সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে অবিভক্ত বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের জনপদ (বর্তমান বাংলাদেশ) খুলনা সদর মহকুমার সঙ্গে সাতক্ষীরা মহকুমা ও বাগেরহাট মহকুমা নিয়ে খুলনা জেলা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে গঠিত হয় খুলনা পৌরসভা। এ সবের আগেই ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে খুলনা থেকে প্রকাশিত হয় সাময়িক পত্রিকা ‘সমাজ দর্পণ’। যশোদা নন্দ সরকারের সম্পাদনায় এই ‘সমাজ দর্পণ’ই খুলনার প্রথম প্রকাশিত পাক্ষিক পত্রিকা। পরবর্তীতে ক্রমাগতভাবে খুলনা হতে অনেক সাময়িক পত্রিকা ও দৈনিক সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। আবার বিভিন্ন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এর মধ্যে অনেক সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্রিকা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তবে এই সকল পত্রিকার মাধ্যমে যেমন সচেতন পাঠক সৃষ্টি হয়েছে তেমনই যোগ্য ও দক্ষ সংবাদপত্র সেবী ও কর্মী গড়ে উঠেছে। আর সমাজ পেয়েছে একটা সংবাদপত্র ও পত্রিকার জগৎ।
বিজ্ঞান-প্রযুক্তি উন্নয়নের সঙ্গে সংগতি রেখে অনলাইন পত্রিকা প্রকাশনা ছিল সময়ের দাবি। তাইতো আমাদের দেশে ইতিমধ্যে গড়ে উঠেছে বেশ কিছু অনলাইন সংবাদপত্র।

আনন্দের বিষয় ২০২০ খ্রিস্টাব্দের ১৩ জুলাই বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের গণমানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, জীবন সংগ্রাম, উন্নয়ন-অগ্রগতি, কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনীতির প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার অন্যতম মুখপত্রের ভূমিকায় খুলনা গেজেট-এর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বিগত ৪ বছরের পথপরিক্রমায় খুলনা গেজেট জনকল্যাণধর্মী ইতিবাচক সাংবাদিকতার স্বাক্ষর রেখে যে গৌরবোজ্জ্বল ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে তা সত্যি প্রশংসনীয়। এ জন্যে খুলনা গেজেটের চতুর্থ বার্ষিকীতে এর প্রকাশনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাই অভিনন্দন। এদের পথচলায় আগামীতেও দেশ ও জাতির কল্যাণে নির্মোহ, নির্ভীক ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার ধারা অব্যাহত রাখবে এই প্রত্যাশাই করি। জয়তু খুলনা গেজেট।

লেখক : প্রাক্তন ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়।

খুলনা গেজেট/এমএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!