এই সেই দেশ। কবি সাহিত্যিকেরা যাকে বহুকাল ধরে বহু নামে সম্বোধন করে পরম তৃপ্তি পেয়েছেন। এই দেশে একটি ফল খেয়ে বীজটি মাটিতে ছুড়ে দিলে সেখানেই একটা গাছ হয়ে আবার ফল ধরে। এখানে জমিতে সোনার ফসল জন্মে সামান্য চাষে। এখানে বৃষ্টি রোদে বিপুল পরিমাণ উৎকৃষ্ট উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। এখানে মানুষেরও জন্ম হয় অতি সহজে ও অধিক পরিমাণে। এইতো আমার বাংলাদেশ।
এখানে মানুষের জন্ম হয় অতি সহজে ও অধিক পরিমাণে। এই কথাটি অতি সহজে বলা গেলেও এর মর্মার্থ একটু ভেবে দেখা দরকার।
পৃথিবীতে কোন মানুষ তার নিজের ইচ্ছায় আসতে পারে না। কে কোন দেশে বা কোন সম্প্রদায়ে জন্ম নিবে তার নিয়ন্ত্রণ কখনও সেই মানুষের হাতে থাকে না। অবশ্য জন্মের পর প্রতিটি মানুষ তার নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী পরিচিতি লাভ করে। মানুষের কর্মই তার প্রকৃত পরিচয়। প্রতিটি মানুষের কর্মের জন্য তার চতুর্পাশের পরিবেশ ও তার দেখা মানুষগুলির কর্মকান্ড তাকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে। একটি শিশু জন্মের পর প্রতিটি পদক্ষেপে যা দেখে, যা শোনে, যেভাবে চারপাশের মানুষদের দেখে নিজেকে সেভাবেই গড়ে তোলে। অবশ্য মাঝে মাঝে কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়। কিন্তু সেটা গণনায় আনা যায় না।
কথাগুলি কেন আসলো তা বলি। করোনাকালীন সময়ে দুই মাসাধিক সময় গ্রামের বাড়িতে থাকলাম। গ্রামে থাকার সুবাদে পাড়ার ছোট ছোট সোনামণিদের নিয়ে একটু খেলাধুলা, তার সাথে একটু পড়াশোনা, কিছু আলোচনা করতে করতে ওদের সাথে রীতিমতো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। আমি ওদের অতি আপনজন হয়ে গেছি। নিছক বন্ধু না হয়ে ওদের মনের ভিতরে ঢুকে একটা নতুন জগৎ গড়তে চেষ্টা করেছি। ওদের মনের ভিতরে ঢুকে প্রত্যেকের প্রতিভা বিকাশে সহায়ক পরিবেশ গড়তে চেষ্টা করেছি। আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করেছি, ওরা প্রত্যেকে এক একটা বিশাল প্রতিভার ভান্ডার। সকলের মাঝে সৃষ্টিকর্তার অপার দান সু্প্ত ছিল। সামান্য একটু সুযোগের অভাবে এতদিন সকল প্রতিভা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। একটুখানি আলোর ছোঁয়া পেয়ে রীতিমতো জ্বলে উঠেছে। এখন আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এদের যদি সঠিকভাবে পরিচর্যা করা যায় তাহলে ওরা প্রত্যেকে জীবনে স্ব স্ব ক্ষেত্রে সাফল্যলাভ করবে।
আবার ভয় হয়, আমি কতোদিন ওদের কাছে থেকে এই কার্যক্রম চালাতে পারবো বা ওদের পরিবার ও পরিবেশ কতটা লালন করতে পারবো। তবে আমি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম সৃষ্টিকর্তার দেয়া মানব সম্পদের সীমাহীন লীলা। তিনি সকল মানুষকে অপার সম্ভাবনা দিয়ে সৃষ্টি করেন তা আর একবার বুঝতে শিখলাম। তিনি কোন মানুষকে অকারণে সৃষ্টি করেন না, তা আরো ভালোভাবে বুঝলাম। আমি আরো বুঝলাম, সকল মানুষ এক একটা বিশাল সম্পদ। শুধু পরিবেশ পরিস্থিতির শিকার হয়ে অধিকাংশ মানুষ পথভ্রষ্ট হয়। তাই আমাদের দেশের পরিবেশের কারণে অধিকাংশ প্রতিভাবান শিশু বিপথে চলে যাচ্ছে। একদিন সৃষ্টিকর্তার সেরা এই মানব সম্পদ দেশের জন্য বোঝা হয়ে পড়বে। আর আমরা দোষ দিচ্ছি নিজেদের ভাগ্যকে। কিন্তু কখনও ভেবে দেখছিনা সবকিছুর জন্য আমরা কতটা দায়ী!
এবার যদি একটু অন্যদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি তাহলে কি দেখবো?
ধরুন একটা ছেলে বা মেয়ে প্রতিকূল পরিবেশে থেকেও মোটামুটি বড় হয়ে কর্মজীবনে গেল। কর্মজীবনের শুরুতে তার একটা নতুন উদ্দীপনা থাকে। মানব সেবার মহান ব্রত নিয়ে সে কাজ শুরু করতে চায়। কিন্তু তার পূর্ববর্তী কর্মজীবীদের কর্মকান্ডে সে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত হয়। সে যখন দেখে তার চারপাশে সকল কর্মজীবীরা মারাত্মকভাবে কলুষিত, তখন সে নিজেকে তাদের মত করতে থাকে। আস্তে আস্তে একদিন সেও হয় কলুষিত। এমনিভাবে ব্যবসা বাণিজ্যে গিয়েও তারা হয় কলুষিত। এভাবে বংশপরম্পরায় আমরা জাতি হিসেবে কলুষযুক্ত হয়ে দিন দিন আরো বেশি অধঃপতনে চলে যাচ্ছি।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দিকে লক্ষ করলে আরো ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠবে। শিশু শ্রেণি থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত আপাদমস্তক কলুষিত। সেখানে কিভাবে গড়ে উঠবে আমাদের পরবর্তী বংশধর?
সমাজের নিয়ন্ত্রক হচ্ছে রাজনীতি ও ধর্ম। সেখানে দৃষ্টি দিলে সবচেয়ে বেশি ভয়াবহ চিত্র চোখে পড়বে। ধর্ম ও রাজনৈতিক অঙ্গনের ভয়াবহতা সমাজকে সবচেয়ে বেশি গ্রাস করেছে। এখানে অধিকাংশই সীমাহীন বেপরোয়া। সমাজের নিয়ন্ত্রণ করে তারা। তাদের দেখে পরবর্তী প্রজন্ম বেড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তী প্রজন্ম কী দেখছে তাদের কাছে?
তাই বলে আমরা কি বলতে পারবো, এদেশ আমার নয়?
এদেশে আমার জন্ম হয়নি?
আমি এদেশ ছেড়ে চলে যাবো?
সৃষ্টিকর্তা কেন আমাকে এদেশে পাঠালেন?
না, কখনওই আমরা অন্য কাউকে দোষ দিয়ে পার পাবোনা। এদেশে আমাকেই থাকতে হবে এবং আমাদেরই কলুষ মুক্ত করতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যেতে হবে একটি সুন্দর বাসযোগ্য বাংলাদেশ। এই দেশকে কলুষ মুক্ত করতে কাউকে না কাউকে বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধতে হবে এবং শুরু করতে হবে দেশের নিয়ন্ত্রণকারীদের।
কে সেই নিয়ন্ত্রণকারী? প্রথমতঃ রাজনীতি! দ্বিতীয়তঃ রাজনীতি! তৃতীয়তঃ রাজনীতি!