সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জনবল সংকটের কারণে স্বাভাবিক চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম কিছুটা হলেও ব্যহত হচ্ছে। এখানে চিকিৎসকের ৯৮টি পদের মধ্যে রয়েছে ৪৫ জন। একই সাথে ১০০ জন পরিচ্ছন্নকর্মীর বিপরীতে রয়েছে মাত্র ২০জন। আয়ার ৫০টি পদের বিপরীতে ১০জন এবং ওর্য়াডবয়ের ৫০টি পদের সবগুলোই শূন্য রয়েছে।
তীব্র এই জনবল সংকটের মধ্যেও পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়েছে সাতক্ষীরা ৫০০ বেডের মেডিকেল কলেজ (সামেক) হাসপাতাল। ২০১১ সালে সিমিত পরিসরে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর এবছর জুলাই মাসে হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হয়েছে। তারপরও সীমিত এই জনবল নিয়ে প্রতিদিন আউটডোরে (বহির্বিভাগ) গড়ে প্রায় দেড় হাজার এবং ভর্তিকৃত গড়ে প্রায় ৪০০ রোগীর চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছেন হাসপাাতলের চিকিৎসক ও নার্সসহ অন্যান্য কর্মীরা।
সামেক হাসপাতাল সূত্র জানায়, ৫০০ বেডের এই সামেক হাসপাতালে এখন লেজার থেরাপির মাধ্যমে কিডনির পাথর অপারেশন, কিডনি ডায়ালাসিস, এন্ডোসকপি সুবিধাসহ বিভিন্ন জটির রোগের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এখানে এনজিওগ্রাম চালুর প্রক্রিয়া চলছে। এর ফলে ২৭২ কিলোমিটার নৌ ও স্থল সীমান্তের এই জেলার মানুষের এখন আর দুই-একটি জটিল রোগ ছাড়া দেশে-বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে হচ্ছে না।
বিগত ২০০৯ সালের ২৩ জুলাই ঘূর্ণিঝড় আইলা দুর্গত উপকূলীয় এলাকা পরিদর্শনে এসে সাতক্ষীরায় একটি মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই ঘোষণার মাত্র দুই বছরের মধ্যে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ,ফ,ম রুহুল হকের প্রচেষ্টায় ২০১১ সালে শহরের টাউন বাজার এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৭ সালে শহরের অদূরে বাকাল এলাকায় নিজস্ব ভবনে শুরু হয় হাসপাতালের আংশিক চিকিৎসা কার্যক্রম। এরপর পর্যায়ক্রমে জরুরী বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগগুলির পাশাপাশি চলতি বছরের জুলাই মাসে ৫০০ বেড হাসপাতালের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রম শুরু হয়।
সূত্র আরো জানায়, করোনা পরিস্থিতি শুরুর পর সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালকে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এখানে ২০২১ সালের ১৬ জুন থেকে ২০০৫ জন করোনা রোগী চিকিৎসা সেবা নিতে ভর্তি হন। এর মধ্যে সুচিকিৎসা পেয়ে সুস্থ্য হয়ে বাড়ি ফিরেছেন ১ হাজার ৮৩৯ জন রোগী। সীমান্তবর্তী জেলা হওয়া সত্ত্বেও সামেক হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার কারণে এখানে মৃত্যুর সংখ্যা তুলনামূলক অনেক কম ছিল।
অসুস্থ বাবা আব্দুর রাজ্জাককে নিয়মিত চেকআপে নিয়ে আসা তালা উপজেলার কামাল হোসেন বলেন, “স্ট্রোকজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়া আমার বাবাকে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করি। যখন নিয়ে এসেছিলাম তখন তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। আইসিইউতে ভর্তি করতে হয়েছিলো। আমার মতো গরীব মানুষের পক্ষে বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউতে ভর্তি করা স্বপ্নের ব্যাপার। সরকারি মেডিকেল বলেই আইসিইউতে রেখে চিকিৎসা করা সম্ভব হয়েছে। আমার বাবা এখন আগের চেয়ে অনেক সুস্থ্য। এখানে চিকিৎসা সেবা না পেলে আমার বাবাকে হয়ত সুস্থ্য করতে পারতাম না।
জেলার কালিগঞ্জ থেকে চিকিৎসা সেবা নিতে আসা গোলম রসুল বলেন, আমার কিডনি সমস্যার কারণে ডায়ালােসিস করতে হয়। সেজন্য আগে ঢাকায় যেতে হতো। এখন এখানেই নিয়মিত ডায়ালােসিস করি।
শ্যামনগরের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার মিজানুর রহমান বলেন, আগে জটিল রোগের কারণে খুলনা, যশোর, ঢাকা অথবা বিদেশ যেতে হতো। সাতক্ষীরা মেডিকেল হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর আমাদের চিকিৎসা নিয়ে আর কোন চিন্তা করতে হয় না। সকল উন্নত চিকিৎসা এখানে পেয়ে থাকি।
জেলা নাগরিক কমিটির আহবায়ক মো: আনিসুর রহিম বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর সাতক্ষীরা থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ২৭০ কিলোমিটার হলেও কোলকাতার দূরত্ব মাত্র ৮০ কিলোমিটার। ফলে জটিল রোগ ছাড়াও অনেকে সাধারণ চেকআপের জন্য ঢাকার পরিবর্তে কোলকাতায় যেতেন। কিন্তু সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর সেই প্রবনতা অনেক কমে গেছে।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের অর্থপেডিক চিকিৎসক ডা. মাহমুদুল হাসান পলাশ বলেন, আমরা সবাই সেবার মন-মানসিকতা নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। এখানে জনবল সংকটসহ অনেক সমস্যা আছে। সব সমস্যা কাটিয়ে আমরা মানব সেবায় কাজ করে যাচ্ছি। এ হাসপাতালে শুধু সাতক্ষীরা জেলার মানুষ নয়, খুলনার পাইকগাছা, কয়রা, যশোরসহ আশে-পাশের এলাকার ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মানুষের আস্থা ও বিশ্বাসের জায়গা তৈরী হয়েছে।
সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. কুদরত-ই-খোদা জনবল সংকটের কথা স্বীকার করে জানান, স্বাস্থ্য খাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অঙ্গীকার পুরোটাই এই মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে এখানকার চিকিৎসক, সেবিকাসহ সকল কর্মী দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন। কয়েকদিন আগেই হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গভাবে চালু করা হয়েছে। এখন অধিকাংশ ভর্তি রোগীর শতভাগ ওষুধ প্রদান করা হচ্ছে। এখানে ৮ বেডের আইসিইউ, ৮ বেডের সিসিইউ, ১৬ বেডের ডায়লাসিস ছাড়াও এন্ডোসকপি, লেজার রশ্মিও মাধ্যমে কিডনির পাথর অপরেশন করা হচ্ছে।
তিনি আরো বলে, হাসপাতালে ভর্তিকৃত গড়ে প্রায় ৪০০ রোগীর চিকিৎসা সেবা প্রদানের পাশাপাশি প্রতিদিন বহির্বিভাগে প্রায় দেড় হাজার রোগী চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। খুব দ্রুত হাসপাতালের এনজিওগ্রাম চালু হবে। জনবলসংকট কাটিয়ে উঠতে পারলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এখানে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে।
খুলনা গেজেট/এমএনএস)