১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধের পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তার আমুল পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর বাঙালি ঘুরে দাঁড়ায়।
১৯৫৮ সালে প্রেসিডেন্ট জেঃ আইয়ুব খান সামরিক শাসন জারির মধ্য দিয়ে বাঙালির কন্ঠকে স্তব্ধ করতে চায়। তখন বিরোধী দল বলতে আওয়ামী লীগ। আর এ সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক পশ্চিম পাকিস্তানীদের বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে ফেডারেল সরকারের অঙ্গ রাজ্য হিসেবে পরিণত করতে চান। স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবি তোলেন। এ দাবিতে ছিল পূর্ব পাকিস্তানের নিকট থাকবে দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যতীত সকল বিষয়। পৃথক অর্থনীতি, পৃথক মুদ্রা ও পৃথক প্যারামিলিটারীসহ পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসন থাকবে। আর এ লক্ষ্যেই তিনি ছয় দফা প্রণয়ন করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের ফসল ছয় দফা। পূর্ব পাকিস্তানের ১৯ জেলায় ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে। ছয় দফা শেখ মুজিবুর রহমানের অনন্য সৃষ্টি। বাঙালির প্রাণের দাবি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্যের চিত্র তুলে ধরায় শেখ সাহেবের জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বি এবং তিনি অপ্রতিদ্বন্দ্বি নেতায় পরিণত হন।
১৯৬৬ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি লাহোর সম্মেলনে ছয় দফা উপস্থাপন করা হয়। উভয় পাকিস্তানে সাড়া পড়ে। ঢাকার দৈনিক আওয়াজ পত্রিকায় ছয় দফা প্রকাশিত হয়।
ছয় দফা প্রশ্নে আওয়ামী লীগের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। দলের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ ছয় দফা প্রশ্নে সভাপতির দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন। খুলনায়ও তার কিছু অনুসারী ছিল। যারা ছয় দফার বিরোধিতা করেন। তার মধ্যে অন্যতম ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ঐতিহাসিক মরহুম এএফএম আব্দুল জলিল।
১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ জাতীয় কাউন্সিলে শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি ও তাজউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ আব্দুল আজিজ ও সাধারণ সম্পাদক মোমিন উদ্দিন আহমেদ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মনোনীত হন।
ন্যাপ এর সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ও ছাত্র ইউনিয়ন ছয় দফাকে সমর্থন করেনি। ন্যাপ প্রধান ছয় দফা সিআইএর কারসাজি বলে চিহ্নিত করেন। তার উক্তি ছিল ছয় দফায় কোন অর্থনৈতিক কর্মসূচি নেই। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনে লাভ হবে না। খুলনা জেলা ন্যাপের সভাপতি ও অধুনালুপ্ত পৌরসভার চেয়ারম্যান এ্যাডঃ আব্দুল জব্বার ও আবু মোহাম্মদ ফেরদৌস ছিলেন এই মতের অনুসারী। তারা ছয় দফার বিপক্ষে অবস্থান নেন।
১৯৬৭ সালে ১২ ডিসেম্বর খুলনা সার্কিট হাউস ময়দানে এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেঃ মোঃ আইয়ুব খান উল্লেখ করেন বিরোধী দল পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে রাষ্ট্রের ধ্বংস চায়। ছয় দফা ঘোষণার পর সরকার শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা দায়ের করেন। (সিরাজ উদ্দিন আহমদ রচিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান)
১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফা অনুমোদনের পর বিকেলে পল্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় রাষ্ট্রদ্রোহী ভাষণ দেয়ার অভিযোগে
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠনের জন্য খুলনার মিউনিসিপ্যাল পার্কে (আজকের শহীদ হাদিস পার্ক) আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ছয় দফার সমর্থনে পার্কের মঞ্চের সামনে ছয়টি প্রতীকী কামান তৈরী করা হয়।