সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালান, হুন্ডি ও আদম ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঝিনাইদহের-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার খুন হয়ে থাকতে পারেন। আনার হত্যায় গ্রেপ্তারদের একজন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবু তার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা বলেছেন।
গ্যাসবাবু বলেছেন, খোদ আনারের বিরুদ্ধে স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ ছিল। আনার ছাড়াও সীমান্তে স্বর্ণ চোরাচালানে আরও ৪ জনপ্রতিনিধির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তারা দীর্ঘদিন ধরে সীমান্ত এলাকায় স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দর দিয়ে চোরাই স্বর্ণ দেশে এনে সীমান্ত এলাকা দিয়ে তারা ভারতে স্বর্ণ পাচার করে থাকেন। কেউ কেউ মায়ানমার সীমান্ত এলাকা দিয়েও পাচার করেন। মায়ানমার হয়ে স্বর্ণ যায় লাওস ও থাইল্যান্ডে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর আনারের সঙ্গে তাদের আর্থিক লেনদেন নিয়ে বিরোধ বাধে। এতে তারা ৪ জন আনারের প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন।
গ্যাস বাবু প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যে ৪ জন প্রতিনিধির নাম বলেছেন, তারা হলেন- পিরোজপুর জেলার একটি আসনের এমপি, ঠাকুরগাঁও জেলার একটি আসনের এমপি, দিনাজপুর জেলার একটি আসনের এমপি এবং নওগাঁ জেলার একটি আসনের এমপি। তারা দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছেন। এই ৪ জনের মধ্যে কোনো কোনো এমপি নিজেদের সমাজ সেবক ও জনদরদী পরিচয়ে তুলে ধরার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন সময় পোস্ট দিয়ে থাকেন। সীমান্ত এলাকায় বড় ধরনের চক্র গড়ে তুলেছেন তারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের বিভিন্ন অপকর্মের ডকুমেন্ট ঊর্ধ্বতন মহলে পেশ করেছেন।
তদন্ত কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, আনার হত্যার পর অনেকটা ধোঁয়াশার মধ্যে ছিলেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা। তবে গ্যাস বাবু গ্রেপ্তার হওয়ার পর এই মামলার রহস্যের জট খুলতে শুরু করে। তিনি তদন্তকারী কর্মকর্তাদের জানান, আনার ছাড়াও ৪ জনপ্রতিনিধি এই স্বর্ণ চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। সীমান্ত এলাকায় তারা স্বর্ণ চোরাচালানের বড় একটি চক্র গড়ে তুলেছেন। এই সব জনপ্রতিনিধি জেলাতে অবস্থান করাকালীন সীমান্ত এলাকাগুলোতে যান। সেখানে গণ-সংযোগের কথা বলে তাদের যে প্রাইভেট বাহিনী রয়েছে, তাদের সঙ্গে চোরাচালানের লেনদেনের হিসাব করে থাকেন।
সূত্র জানায়, অনেকটা কাট-আউট পদ্ধতিতে তারা এই চোরাকারবারে লিপ্ত আছেন। একজনের হাত দিয়ে অন্যজনের হাতে স্বর্ণ প্রদান ও টাকা লেনদেন করে থাকেন তারা। যারা সীমান্ত এলাকায় চোরাই স্বর্ণ নিয়ে ধরা পড়েছেন, তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার পর এইসব গডফাদারের নাম বলে দেওয়ায় এদের নাম জানতে পেরেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে তারা ভিআইপি হওয়ায় ছাড় পেয়েছেন। এই স্বর্ণ চোরাকারবারি করে এই ৪ সংসদ সদস্য বিপুল পরিমাণের অবৈধ সম্পদ গড়ে তুলেছেন।
সূত্র জানায়, গ্যাস বাবু প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, এই চক্রটি শুধু স্বর্ণ চোরাচালানই নয়, হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত। এতে সীমান্তের ওপারে বড় চক্র গড়ে উঠেছে। এই কারণে এই ৪ জনপ্রতিনিধির ভারতে ঘন ঘন যাতায়াত আছে। কেউ মাসে দুইবারও ভারতে গেছেন। এই কারবারে প্রত্যেক মাসে তারা ৫ থেকে ৬ কোটি টাকা অবৈধ পন্থায় আয় করে থাকেন।
সূত্র জানায়, এই চার সংসদ সদস্যের সঙ্গে আনারের ঘনিষ্ঠতা ছিল। চোরাচালানে কোনো সমস্যা হলে তারা আনারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেন।
সূত্র জানায়, সীমান্তে স্বর্ণ পাচারের যে সব রুট রয়েছে, তার মধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি জেলা রয়েছে। এগুলোর সীমান্ত এলাকায় লোকজনের যাতায়াত বেশি হওয়ার কারণে স্বর্ণ পাচার বেশি হয়ে থাকে। সেই সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছেন এই ৪ জনপ্রতিনিধি। এরা মাফিয়া জগতে হোয়াইট গোল্ড ক্রিমিনাল নামে পরিচিত।
আনার হত্যার ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর মধ্যে গত ৬ জুন রাতে ঝিনাইদহ শহরের আদর্শপাড়া এলাকা থেকে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে আটক করে ডিএমপির ডিবি পুলিশের একটি দল। ৯ জুন তাকে সাত দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। গত ১৪ জুন আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন বাবু। তিনি অকপটে পুলিশকে সব তথ্য বিস্তারি/এনএমতভাবে দিয়েছেন।
খুলনা গেজেট/এনএম