যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের আড়াই কোটি টাকার চেক জালিয়াতির মামলায় হিসাব সহকারী আব্দুস সালামসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে দুদক। আড়াই কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে মামলা হলেও দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে ছয় কোটি ৭৪ লাখ ৪৩ হাজার তিন টাকা আত্মসাতের ঘটনা।
চাজশিটে অভিযুক্ত অন্যরা হলেন, ভেনাস প্রিন্টার্স এর প্রোপ্রাইটর শরিফুল ইসলাম, হাইকোর্ট মোড়ের শাহী লাল স্টোরের প্রোপ্রাইটর আশরাফুল আলম, পোস্ট অফিসপাড়ার নুর এন্টার প্রাইজের প্রোপ্রাইটর গাজী নূর ইসলাম, লোহাপট্টির প্রত্যাশা প্রিন্টিং প্রেসের প্রোপ্রাইটর রুপালি খাতুন, হিসাব সহকারী আব্দুস সালামের ভাই উপশহর এলাকার সহিদুল ইসলাম, উপশহরের সোনেক্স ইন্টারন্যাশনালের প্রোপ্রাইটর রকিব মোস্তফা, শিক্ষাবোর্ডের সহকারী মূল্যায়ন অফিসার আবুল কালাম আজাদ, নিম্মমান সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর জুলফিকার আলী, চেক ডেসপাসকারী মিজানুর রহমান ও কবির হোসেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের মঞ্জুরীর ভিত্তিতে বুধবার মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশন যশোর কার্যালয়ের উপ-পরিচালক আল আমিন আদালতে এ চার্জশিট জমা দিয়েছেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুদকের পিপি সিরাজুল ইসলাম।
এছাড়া এ মামলা থেকে যশোর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোল্লা আমীর হোসেন ও সচিব অধ্যাপক এএম এইচ আলী আর রেজাকে অব্যাহতির আবেদন জানানো হয়েছে।
এর আগে ২০২১ সালের ১৮ অক্টোবর দুর্নীতি দমন কমিশন সমন্বিত জেলা কার্যালয় যশোরের সহকারী পরিচালক মাহফুজ ইকবাল বাদী হয়ে সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে পাঁচ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। চার্জশিটে নতুন করে আটটজনের জড়িত থাকার বিষয়টি দুদকের তদন্তে উঠে এসেছে। চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে, হিসাব সহকারী আব্দুস সালামসহ অন্যরা বিভিন্ন সময় ৩৮ টি চেক জালিয়াতি করে এ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড যশোরের প্রায় ২৫ টি হিসাব সোনালী ব্যাংক লিমিটেড, বিআইএসই শাখা যশোরে পরিচালিত হয়। তার মধ্যে একটি হিসাবের ব্যয় নির্বাহ করা হয় ওই হিসাবের সিগনেটরি বোর্ডের সচিব ও চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরে। ব্যাংক শাখাটি বোর্ডের ক্যাম্পাসে অবস্থিত।
দুদকের তদন্তে উঠে আসে , ২০১৬-২০১৭ অর্থবছর হতে যশোর শিক্ষা বোর্ডের সরবরাহ, সেবা ও পারিশ্রমিকসহ সকল বিল ও টাকার পরিমাণসহ চেক লিখনের অনুমতি নিজস্ব অনলাইন সফটওয়ারের মাধ্যমে উপস্থাপন ও অনুমোদন হয়। পরবর্তীতে সফটওয়ারের মাধ্যমে শুধু চেক নাম্বার ইনপুট করে সিঙ্গেল কমান্ডের মাধ্যমে সম্পূর্ণ চেক মুড়ি, মূল চেক, কাস্টমার কপি প্রিন্ট করা হয়। এজন্য সোনালী ব্যাংক লি: বিআইএসই শাখা থেকে যে চেক সরবরাহ করা হয়, তা সোনালী ব্যাংকের সাধারণ চেকের মত না। এটি এ ফোর সাইজের পাতায় প্রিন্ট করা চেক ওই চেকের তিনটি অংশ থাকে । সেগুলো হলো চেকের বামদিকে মুড়ি অংশ, ডানদিকের উপরের অংশে প্রাপককে প্রদেয় একনলেজমেন্ট/কাস্টমার অংশ এবং ডান দিকের নিচের অংশে মূল চেক। প্রিন্টেড চেকের তিনটি অংশে একই তথ্য ও একই টাকার পরিমাণ কথায় ও অংকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সন্নিবেশিত হয়, পরে চেকের প্রিন্টকারী বা ক্যাশিয়ার নিজে প্রিন্টেড চেকের মুড়িতে স্বাক্ষর করে চেক প্রস্তুতির অনুমোদিত শিটসহ চেক স্বাক্ষরের জন্য সম্পূর্ণ চেকটি বোর্ডের দুইজন সিগনেটরি সচিব ও চেয়ারম্যানের কাছে দাখিল করেন। পরে তৎকালীন সচিব ও চেয়ারম্যান উভয়ে চেকটির মুড়ি অংশ, একনলেজমেন্ট/কাস্টমার কপি অংশ ও মূল চেকের টাকার পরিমাণ মিলিয়ে দেখে স্বাক্ষর করেন এবং ডেচপাসের জন্য ক্যাশিয়ার/ডেসপাস রাইডার এর নিকট প্রদান করেন। ক্যাশিয়ার/ডেসপাস রাইডার চেকের মুড়ির বিপরীত পৃষ্ঠায় প্রাপকের স্বাক্ষর নিয়ে বা বোর্ডের চেক ইস্যু রেজিস্টারের লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে প্রাপকের স্বাক্ষর নিয়ে চেক ডেসপাস করেন।
কিন্তু ওই ৩৮ টি চেক ডিসপাসের আগে অভিযুক্তদের যোগসাজসে চেকের পে টু অংশে, কথায় ও অংকে লেখা টাকার পরিমানের তথ্য ঘষামাজার মাধ্যমে মুছে টাকার পরিমান বাড়িয়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে প্রিন্ট করে ইচ্ছে মত বসান। এবং তা জালজালিয়াতি ও বিভিন্ন নামে বেনামে বিলভাউচার তৈরী করে ওই টাকা আত্মসাৎ করেন।
দুদকের তদন্তে আরও উঠে এসেছে, দূর্বল আর্থিক ব্যবস্থাপনার কারণে এ জালিয়াতি হয়েছে। ওই সময়ে যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। এমনকি ওই সময় কোনো অডিটও হয়নি। ফলে ওই সময়ের দায়িত্বে থাকা দুই চেয়ারম্যান প্রফেসর মোহাম্মদ আব্দুল আলীম, অধ্যাপক ড. মোল্লা আমীর হোসেন, সাবেক দুই সচিব প্রফেসর এ এম এইচ আলী আর রেজা ও প্রফেসর তবিবার রহমান, সহযোগি অধ্যাপক ও উপপরিচালক এমদাদুল হক ও অডিট অফিসার আব্দুস সালাম আজাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মধ্যে চারজন অবসর গ্রহন করায় এমদাদুল হক ও আব্দুস সালামের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অভিযোগনামা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।
খুলনা গেজেট/এইচ