“মানুষ বলে মৃত্যুর পরে নরকে ঠাঁই হবে। জানি না মৃত্যুর পরে সেই নরক কেমন, তবে আমি জীবিত অবস্থাতেই সেই নরক দেখে এসেছি।”
বলছিলেন কলকাতার লাগোয়া এক জেলার বাসিন্দা এক তরুণী, যাকে বাংলাদেশি সাজিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়েছিল পুলিশ-আর তার ফলে তাকে দু’দফায় মোট এক বছরেরও বেশি সময় জেলে থাকতে হয়েছে।
দক্ষিণ দিনাজপুরের হিলি সীমান্ত অঞ্চলে ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধরা পড়েছিলেন ২০ বছরের ওই তরুণী।
বিবিসি বাংলাকে ওই তরুণী বলছিলেন, “মানুষের জীবনে একেকটা সময় আসে, যখন পারিবারিক সমস্যার কারণে ভীষণ অবসাদ চলে আসে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে চলে গিয়েছিলাম।”
“কথায় বলে না যেদিকে দু’চোখ যায় সেদিকে চলে যাব, আমার হয়েছিল সেই অবস্থা। তার আগে আমি হিলির নামও শুনি নি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে পৌঁছিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে।”
“পুলিশ দেখেই প্রথম রিয়ালাইজ করি যে ওখানে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি ফিরে আসার চেষ্টা করি, কিন্তু ততক্ষণে পুলিশ আমাকে আটকিয়ে দেয়। তারা বলেছিল যে আমাকে একটা ক্যাব ঠিক করে দেবে – যাতে বাড়ি পৌঁছতে পারি।”
“থানায় নিয়ে আসা হয় আমাকে। তখনও বলা হচ্ছিল যে বাবাকে খবর দেবে, তিনি গিয়ে নিয়ে আসবেন। তার আগে পুলিশ, থানা এসব নিয়ে কোনও ধারণাই ছিল না আমার,” বলছিলেন বিউটিশিয়ানের কাজ করা ওই তরুণী।
যেভাবে পুলিশ তাকে বাংলাদেশী সাজিয়েছিল
সীমান্ত থেকে পুলিশ যখন তাকে থানায় নিয়ে আসে, সেখানে নথিতে লেখা হয় যে ওই তরুণী আসলে বাংলাদেশের নবাবগঞ্জ জেলার বাসিন্দা। তার বাবার একটা কল্পিত নামও নথিভুক্ত করা হয়।
তিনি ভারতীয় ভূখণ্ডে আসার কোনও নথি দেখাতে পারেননি বলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয় বিদেশী আইনের ১৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী।
“অথচ আমাকে যখন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিল যে কোথায় বাড়ি, বারে বারে আমি আমার জেলার নাম, এলাকার নাম বলেছি পুলিশকে,” জানাচ্ছিলেন তরুণী।
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী যে চূড়ান্ত রায় দিয়েছেন, সেখানে এই বিষয়টি দিয়েই রায় শুরু করেছেন তিনি।
“আমাকে যখন কোর্টে দিল, তখনও আমাকে বলা হয়েছিল যে ছাড়া পেয়ে যাব সেখান থেকে। কিন্তু আমাকে কোর্ট থেকে পাঠিয়ে দিল জেলে। বাড়িতে কোনও খবর দেওয়া হয়নি। দ্বিতীয় হিয়ারিংয়ের দিন সরকার থেকে ঠিক করে দেওয়া উকিল আমার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে বাবাকে খবর দেন। পরের দিনই বাবা ওখানে পৌঁছায়। তার আগে বাবা আমাদের স্থানীয় থানায় আমার নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ডায়েরি লিখিয়েছিল,” বলছিলেন নাম পরিচয় গোপন রাখতে ইচ্ছুক ওই তরুণী। সেই দফায় প্রায় দেড় মাস জেলে কাটাতে হয়েছিল ওই তরুণীকে।
‘চিৎকার করে আদালতে বলেছি আমি বাংলাদেশী না’
জেল থেকে বাড়ি ফিরে আসার পরে প্রতি শুনানির দিনই তিনি হাজির হতেন আদালতে। তার কথায়, “তখন আমরা ভাবতাম যে ভুল তো একটা আমারই হয়েছে ওখানে চলে গিয়ে, কিন্তু আমি যেহেতু ভারতীয়, সব প্রমাণ আছে, তাই কিছু হবে না। কোর্ট নিশ্চয়ই আমাকে প্রমাণ দেখে ছেড়ে দেবে। এতটাই কনফিডেন্ট ছিলাম, যেদিন রায় হবে সেদিন আমি একাই গিয়েছিলাম কোর্টে।”
“কিন্তু যখন আমাকে বলা হল গিল্টি, কনভিক্টেড, আমি বেশ কিছুক্ষণ পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গিয়েছিলাম। বারে বারে চিৎকার করে বলেছি যে আমি বাংলাদেশী না।”
“ভাবতেই পারিনি যে এত প্রমাণ জমা দেওয়ার পরেও আমাকে দোষী বলা হবে আর চার বছরের জেলের সাজা হয়ে যাবে!”
দ্বিতীয় দফায় তাকে ১১ মাস জেলে কাটাতে হয়, তারপরে তিনি জামিন পান।
অদ্ভুত যুক্তিতে সাজা নিম্ন আদালতের
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী এই প্রশ্ন তুলেছেন তার রায়ে যে নিম্ন আদালত এক অদ্ভুত যুক্তি দিয়ে ওই তরুণীকে চার বছর কারাবাসের সাজা দিয়েছিল।
তরুণীর বাবা আদালতেও সেই মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার ডায়েরি জমা দিয়েছিলেন।
তিনজন সরকারী কর্মকর্তা আদালতে হাজির হয়ে তিনটি আলাদা নথি জমা করেন, যার মধ্যে ছিল তরুণীর মাধ্যমিক পাশের সার্টিফিকেট, রেশন কার্ড আর ভোটার লিস্টের প্রতিলিপি।
কিন্তু তখন নিম্ন আদালত যুক্তি দেয় যে তরুণীর মা যেহেতু আদালতে হাজির হন নি, শুধু বাবা এসেছেন, তাই তরুণী যে ভারতীয়ই, তা প্রমাণ হয় না।
হাইকোর্টের রায়ে পুলিশী তদন্তে চূড়ান্ত গাফিলতির কথাও বারে বারে তুলে ধরা হয়েছে।
পুলিশী তদন্তেও চূড়ান্ত গাফিলতি
তরুণীর আইনজীবী নিগম আশিস চক্রবর্তী বলছিলেন, পুলিশী তদন্তে গাফিলতি আর নিম্ন আদালতের অযৌক্তিক রায়ের ক্ষেত্রে হাইকোর্টের রায় একটা গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হয়ে থাকবে।
মি. চক্রবর্তীর বলছিলেন, “যে চারজন সরকার পক্ষের সাক্ষী ছিলেন, তার মধ্যে প্রথম ছিলেন মামলার তদন্তকারী অফিসার। কোর্টই তাকে নির্দেশ দিয়েছিল যে ওই তরুণীর এলাকার যে থানায় নিখোঁজ ডায়েরি হয়েছিল, সেটা যথার্থতা যাচাই করে আসতে। সেই অফিসার স্থানীয় থানায় এসে নিখোঁজ ডায়েরি সত্যতা যাচাই করে গিয়ে রিপোর্টও দিয়েছিলেন।
“সেটা তিনি আদালতে জানিয়েও চূড়ান্ত চার্জশিটে সেটা উল্লেখ করেননি। নিম্ন আদালতে মামলাটা তো সেখানেই শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরেই সাক্ষ্য গ্রহণ চলতে থাকে আর রায় দেওয়া হয় চার বছরের জেলের।”
“পুরো তদন্ত প্রক্রিয়া আর বিচার প্রক্রিয়া দুটোই ভয়াবহভাবে গণ্ডগোল পাকিয়ে ফেলা হয়েছিল,যার ফল হল এই তরুণীকে প্রায় এক বছর জেল খাটতে হল। এতগুলো বছর ধরে মামলা চালাতে হল,” বলছিলেন মি. চক্রবর্তী।
‘জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল, তবে হবু বর পাশে ছিল’
তরুণী জানাচ্ছিলেন,”আমি হাইকোর্ট থেকে মুক্তি পেয়েছি ঠিকই, একটা দুর্বিষহ জীবন থেকে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু আমার জীবন আর কেরিয়ার তো পুরো ধ্বংস হয়ে গেল বলতে গেলে।
ওই তরুণীর বিয়ে ঠিক হয়ে গিয়েছিল তার সাজা হওয়ার আগে। তার হবু বর আর শ্বশুরবাড়ি অবশ্য সবসময়ে পাশে থেকেছে তরুণীর।
“ওরা সবসময়ে বলে এসেছে যে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। পুরো সময়টা আমার পরিবার আর ওদের পরিবার আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল,” বলছিলেন তরুণী।
মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোর প্রচেষ্টা
এরকম অনেক ঘটনাই সামনে আসে, যেখানে সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দা ভারতীয় নাগরিকদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দিয়ে জেলে পাঠানো হয়ে থাকে। কখনও সেসব হয় মাদক পাচারের অভিযোগ, কখনও আবার বাংলাদেশী সাজিয়ে মামলা দেওয়া হয়।
এমন যে শুধু সীমান্ত অঞ্চলেই হচ্ছে – তা নয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দাদের বাংলাদেশি সন্দেহে গ্রেপ্তার করছে দিল্লি, মুম্বাই, আর কর্ণাটকের পুলিশ ।
ভারতীয় নাগরিকদের প্রমাণ পেশ করার পরেও বহু মানুষকে জেলেই কাটাতে হচ্ছে বিদেশী তকমা নিয়ে। বিবিসি বাংলা।