গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর ৮-১০টি মোটরসাইকেল এসে থামে শিপইয়ার্ড সড়কের রূপসা স্ট্যান্ড রোডে। বহরে থাকা যুবকদের হাতে ছিল রামদা, হকিস্টিক, চায়নিজ কুড়াল। দু’জনের হাতে দেখা গেছে পিস্তলও। সন্ত্রাসীরা সড়কের পাশের কাঠের গোলায় ঢুকে দু’জনকে খুঁজতে থাকে। কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে না পেয়ে চলে যায়। পরে জানা যায়, তারা খুলনার আলোচিত সন্ত্রাসী আশিক বাহিনীর সদস্য।
এক মাস ধরে এমন দৃশ্য দেখা যায় নগরীর শেখপাড়া এলাকায়। ৪-৫টি মোটরসাইকেলে চায়নিজ কুড়াল, পাইপগান, রামদা, বন্দুক নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এক দল যুবক। তাদের নেতা শেখপাড়া বাজার এলাকার আমীর চাঁনের ছেলে শামীম খুলনার আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেনেড বাবুর অন্যতম সহযোগী। গত এক মাসে এক ডজন দোকানে চাঁদাবাজি, মারধরসহ নানা ঘটনার জন্ম দিয়েছে তারা।
শুধু আশিক বা গ্রেনেড বাবুই নয়; দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে থাকা আলোচিত সন্ত্রাসী নূর আজিম ও তাদের সহযোগীরা এখন এলাকায়। এই তিন সন্ত্রাসী বাহিনীর সদস্যরা রূপসা স্ট্যান্ড রোড, চাঁনমারী, রূপসা মাছ বাজার, শেখপাড়া বাজার, গোবরচাকা, টুটপাড়া, জিন্নাহপাড়া, লবণচরা, চাঁনমারী বাজার, বানিয়াখামারসহ আশপাশ এলাকায় প্রতিদিনই সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে। কিছুদিন আগে কুপিয়ে আহত করেছে ৩১ নম্বর ওয়ার্ড যুবদল সভাপতিকে।
ভুক্তভোগীরা জানান, এলাকার বাজারগুলোয় চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটছে অহরহ। প্রথম দিকে সন্ত্রাসীদের ভয়ে শেখপাড়া, রূপসা ও চাঁনমারী বাজারের অনেক ব্যবসায়ী বাজারে যাননি। পরে চাঁদা দিয়ে অনেকে দোকান খুলেছেন। তাদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে সাহস পাচ্ছে না মানুষ। এমনকি বিএনপি নেতারাও তাদের বিষয়ে চুপ।
বিষয়টি স্বীকার করে খুলনা সদর থানার ওসি কামাল হোসেন খান বলেন, সন্ত্রাসীদের আনাগোনার বিষয়টি শুনেছি। শুধু আশিক বাহিনীর বিরুদ্ধে রূপসা মাছ বাজারে চাঁদাবাজির ঘটনার অভিযোগ পেয়েছি।
নগরীর দৌলতপুর এলাকার অবস্থা আরও খারাপ। চরমপন্থি দলের সদস্যরা ১৫-১৬ বছর পর এলাকায় ফিরেছে। জামিন পেয়ে কারামুক্ত হয়েছে হুজি শহীদ হত্যাসহ একাধিক মামলার আসামি রিফুজি মঈন ও আসলাম ওরফে ট্যারা আসলাম। প্রায় দেড় যুগ পর এলাকায় ফিরে রীতিমতো বিচার-সালিশ করছে শীর্ষ সন্ত্রাসী টাইগার খোকনের প্রধান সহযোগী বড় শাহীন। নিজের লোকজন দিয়ে কারাগার থেকেও চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে চরমপন্থি নেতা শাহাদাত হোসেন লিটন ওরফে খোড়া লিটনের বিরুদ্ধে। বিষয়টি কারা কর্তৃপক্ষকে জানানোর পর কেরানীগঞ্জ কারাগারে তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সম্প্রতি বিএনপি নেতাদের ছবি ব্যবহার করে এলাকায় পোস্টারও লাগিয়েছেন খোড়া লিটন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বিএনপি নেতা বলেন, সব দেখছি, কিন্তু এদের বিরুদ্ধে বলব কাকে? নিষেধ করা বা পুলিশকে জানালে দেখা যাবে, কাল রাস্তায় আমার লাশ পড়ে থাকবে। এজন্য ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না।
দৌলতপুর থানার ওসি শহিদুল ইসলাম বলেন, নানা রকম সংবাদ আমাদেরও কানে আসছে। তথ্য পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে কেউ মুখ খুলতে চায় না। আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছি।
দেড় দশক ধরে খুলনার খুন, মাদক বিক্রিসহ অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনটি বাহিনীর নাম জড়িয়ে আছে। হত্যাসহ ডজনখানেক মামলার আসামি রনি চৌধুরী বাবু ওরফে গ্রেনেড বাবু, নূর আজিম ও আশিক। এর মধ্যে গ্রেনেড বাবু ‘বি কোম্পানি’, নূর আজিম ‘ভ্যাম্পায়ার গ্রুপ’ এবং আশিক ‘আশিক বাহিনী’ হিসেবে সন্ত্রাসীদের কাছে পরিচিত।
গত বছর খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের করা একটি তালিকায় দেখা যায়, আশিকের বাহিনীতে ২৩ জন, নূর আজিমের বাহিনীতে ১৪ জন ও গ্রেনেড বাবুর বাহিনীতে ৬ জন অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দুই শতাধিক মামলা রয়েছে। পুলিশের ধরপাকড় ও মামলার কারণে বেশির ভাগ সময়ই তারা পলাতক জীবনযাপন করত। তবে ৫ আগস্টের পর তাদের সবাই এলাকায় ফিরেছে।
সম্প্রতি খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, বাহিনীর সদস্য সংখ্যা এখন কয়েকগুন বেড়েছে। নগরীর প্রতিটি ওয়ার্ডে বি কোম্পানি মাদক বিক্রেতা রয়েছে। ২২, ৩০ ও ৩১নং ওয়ার্ডের প্রতিটি পাড়ায় আশিকের পৃথক গ্রুপ রয়েছে। ভ্যাম্পায়ার বাহিনীর দাপট শহরের সীমান্তবর্তী গ্রামেও ছড়িয়েছে। সবাই এলাকায় সশস্ত্র মহড়াসহ বিভিন্ন ধরনের অপরাধ করছে।
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) তাজুল ইসলাম বলেন, খুব শিগগিরই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হবে। নগরীতে কোনো অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীর জায়গা হবে না।
সূত্র : সমকাল