তিনি মানেই টোলপড়া হাসিমাখা মুখ। ভুবনমোহিনী হাসিমুখ ও সুনিপুণ অভিনয়ের জন্য যাঁকে সবাই ডাকেন ‘মিষ্টি মেয়ে’ বলে, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তী সেই অভিনেত্রী সারাহ বেগম কবরী আর নেই। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ১৩ দিনের মাথায় তিনি চলে গেলেন অনন্তলোকে। শুক্রবার রাত ১২টা ২০ মিনিটে রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন বলে তাঁর ছেলে শাকের চিশতী জানিয়েছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭০ বছর।
গত ৫ এপ্রিল খুসখুসে কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর কবরীর করোনার নমূনা পরীক্ষা করা হলে ফল পজেটিভ আসে। ওই রাতেই তাঁকে ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৭ এপ্রিল রাতে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। ৮ এপ্রিল দুপুরে শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। অবস্থার আরো অবনতি হলে গত বুধবার বিকেলে তাঁকে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না।
অতুলনীয় অভিনয় দিয়ে কোটি কোটি ভক্তের হৃদয় জয় করা কবরী ক্যামেরার পেছনে পরিচালকের আসনেও ছিলেন সফল। তেমনি সফল তিনি রাজনীতিতেও। তাঁর মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু, দলের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ পৃথক শোক বার্তায় গভীর শোক জানিয়েছেন।
চট্টগ্রামের বোয়ালখালীতে ১৯৫০ সালের ১৯ জুলাই জন্ম সারাহ বেগম কবরীর। তাঁর আসল নাম মীনা পাল। শৈশব ও কৈশোর কেটেছে চট্টগ্রাম নগরীতে। ঢাকার চলচ্চিত্রে এসে তিনি কবরী নামেই পরিচিতি পান। পরে তিনি সারাহ বেগম কবরী নাম ধারণ করেন।
সুভাষ দত্তের পরিচালনায় ‘সুতরাং’ সিনেমার নায়িকা হিসেবে কবরীর অভিনয় জীবনের শুরু। যা মুক্তি পেয়েছিল ১৯৬৪ সালে। এরপর অভিনয় করেছেন তিন শতাধিক ছবিতে। ভারতের কীর্তিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা ঋত্বিক ঘটকের সিনেমা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, জহির রায়হান নির্মিত উর্দু সিনেমা ‘বাহানা’, গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তর দশকের জনপ্রিয় সিনেমা ‘হীরামন’, ‘ময়নামতি’, ‘সুজন সখী’, ‘চোরাবালি’, ‘পারুলের সংসার’, ‘বিনিময়’, ‘স্মৃতিটুকু থাক’, ‘সারেং বউ’, ‘আগন্তুক’সহ বহু চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বাংলা সিনেমার জগতকে উজ্জ্বল করেছেন।
ষাট ও সত্তর দশকে এদেশের চলচ্চিত্র রাজত্ব করা প্রায় সব নায়কের প্রথম নায়িকা হিসেবে অভিনয়ের গৌরব একমাত্র কবরীরই। প্রথম ছবির নায়ক ছিলেন সুভাষ দত্ত। প্রথম চলচ্চিত্র ব্যাপক সাড়া ফেলায় আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাঁকে। ধীরে ধীরে পাকাপোক্ত করে নিলেন বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁর সিংহাসন। পরের বছরই ‘জলছবি’তে নায়ক হয়ে আসেন ফারুক। ফারুকের সঙ্গে ১৯৭৫ সালে অভিনীত ‘সুজন সখী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। রাজ্জাকের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হন ১৯৬৮ সালে ‘আবির্ভাব’ ছবির মাধ্যমে।?তখন ছিল উর্দু ভাষার চলচ্চিত্রের জোয়ার। চলচ্চিত্রে নতুন মুখ কবরীকে পেয়ে ভাটা পড়ল উর্দুভাষার চলচ্চিত্রে। শবনম-রহমান ও শাবানা-নাদিমের বিপরীতে বাংলা সিনেমার রাজ্জাক-কবরী জুটিও পাল্লা দেয়। রাজ্জাক-কবরী জুটি এ দেশের চলচ্চিত্রের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটিতেও পরিণত হন। এই জুটিকে বলা হতো বাংলাদেশের উত্তম-সুচিত্রা। আজ পর্যন্ত জনপ্রিয়তার শীর্ষে এ দুজনের জুটিবদ্ধ চলচ্চিত্র। নায়ক উজ্জ্বলের প্রথম ছবি ‘বিনিময়’ (১৯৭০), সোহেল রানার প্রথম ছবি ‘মাসুদ রানা’ (১৯৭৪), আলমগীরের প্রথম ছবি ‘আমার জন্মভূমি’ (১৯৭৯) এর নায়িকা ছিলেন কবরী। নায়ক জাফর ইকবালও কবরীর সঙ্গে জুটিবদ্ধ হয়ে নায়ক হিসেবে অবির্ভূত হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে পরিবারের সঙ্গে ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি চলে যান কবরী। সেখান থেকে ভারতে পাড়ি দেন। আগরতলা থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করেছেন একজন কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে।
আশির দশকে চলচ্চিত্রে অশিলতা গ্রাস করলে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নেন। অভিনয় ছাড়াও চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন, করেছেন পরিচালনাও। ২০০৬ সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘আয়না’ মুক্তি পায়। ‘সারেং বৌ’ ছবিতে জয়তুন চরিত্র অভিনয়ের জন্য কবরী সারোয়ার ১৯৭৮ শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৩ পেয়েছেন আজীবন সম্মাননা। কবরীর লেখা ‘স্মৃতিটুকু থাক’ নামের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে ।
তিনি কেবল বড়পর্দার নায়িকা হিসেবেই মানুষের হূদয় জয় করেননি। রাজনীতির মাঠেও সাধারণ মানুষের হূদয় জয় করেছেন। ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নারায়ণগঞ্জ থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। চলচ্চিত্রের নায়িকা থেকে সরাসরি ভোটে তিনিই প্রথম নির্বাচিত হন।
সমপ্রতি কবরী শুটিং শেষ করেন ‘এই তুমি সেই তুমি’ সিনেমার। সরকারি অনুদানের এই ছবির ডাবিং ও সম্পাদনার কাজ চলছিল। ছবিটিতে কবরীর পরিচালনায় প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নিশাত সালওয়া ও রিয়াদ রায়হান। ছবিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ও করেন কবরী। এই ছবির সংগীত পরিচালনা করেছেন সাবিনা ইয়াসমীন। এরই মধ্যে নতুন আরেকটি সিনেমা নির্মাণের পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছিলেন এই বরেণ্য অভিনেত্রী।
খুলনা গেজেট/এনএম