আজ থেকে ৭৪ বছর আগের কথা। ১৯৫০ সালের ১১ ডিসেম্বর চালনা এঙ্করেজের সূচনা হয়। তখনো চালনা বন্দর কর্তৃপক্ষ নাম ধারণ করেনি। পশুর নদীর জয়মনির গোল-এ “সিটি অব লিয়ন্স” নামের একটি বিদেশী জাহাজ নোঙ্গর করে। বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজটির ছবিটি প্রয়াত সাংবাদিক মনিরুল হুদা ক্যামেরাবন্দি করেন। তখন তিনি মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থী। পিতা বাগেরহাট মহকুমার প্রশাসক। এ কারণেই তিনি বন্দরের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ পেয়েছিলেন। তাঁর ধারণ করা ছবিটিই পরবর্তীতে বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক প্রকাশিত ইয়ার-বুকে ছাপা হয়।
মাধ্যমিক পর্যায়ের ছাত্র থাকা কালীন ভাষা আন্দোলনের সম্পৃক্ততা, অস্ত্র গুলি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেপথ্যে সহযোগীতা করা এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা আন্দোলনে সাংবাদিক মহলকে যুক্ত করায় তিনি ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন। খুলনার গণমাধ্যম ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ নামক গ্রন্থে তার বর্ণাঢ্য জীবনী ছাপা হয়েছে। জীবদ্দশায় একাধিকবার নিজ জীবনী পড়েছেন এবং খুলনা মডেল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় ও খুলনা রিপোর্টার্স ইউনিটি আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে গর্বের সাথে বিষয়টি উপস্থিতিদের সামনে তুলে ধরেন। নিকট আত্মীয় ও স্বজনদের মাঝে এ গ্রন্থটি উপহার হিসেবে দিয়েছেন। গ্রন্থটি তার সংগ্রহশালায় সযত্নে সংগ্রহে রয়েছে। স্ব-শরীরে আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর কর্মময় জীবন ইতিহাসের পাতায় যুগ যুগ স্মরণীয় হয়ে থাকবে। যা আগামী প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা যোগাবে।
তিনি খুলনার সকল স্তরের মানুষের কাছে শ্রদ্ধাভাজন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। আস্থার প্রতীক। খুলনার সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতায় এক কিংবদন্তী। এ অঞ্চলের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকদের গর্ব ও অহংকারের অগ্রজ সহকর্মী। তিনি দক্ষ পেশাজীবী হিসেবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য উদাহরণ। পাকিস্তান পর্বে এবং বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের নানা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। ১৯৫২ সাল থেকে শুরুর করে শুক্রবার অবধি তিনি সংবাদপত্র জগতে পদচারণা করে চলেছেন। এ গর্ব দক্ষিণাঞ্চলবাসীর। খুলনার সাংবাদিকতায় এক অনন্য ইতিহাস। ৬৯ বছর সংবাদকর্মী হিসেবে সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে উদাহরণ একমাত্র তিনি। দীর্ঘ সময়ে খুলনার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা, শিল্প-কলকারখানা স্থাপন, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, পীর খানজাহান আলী (র.) সেতু, মেডিকেল কলেজ, বিমান বন্দর, শহর রক্ষা প্রকল্প, মংলা বন্দর আধুনিকায়ন, সর্বোপরি সুন্দরবনকে অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে তিনি ধীমান সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর নানামূখী প্রতিভা দৃশ্যমান। তিনি ভাষা সৈনিক, সাবেক ছাত্রনেতা, সাংবাদিক নেতা, আয়কর আইনজীবী ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা রেখেছেন।
বৃটিশ শাসনামলে মনিরুল হুদা বাগেরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। দিনটি ১৯৩৭ সালের ২৭ নভেম্বর। মরহুম সামছুল হুদা তাঁর পিতা। তিনি বাগেরহাটে মহকুমা প্রশাসক ছিলেন। মরহুমা আমেনা খাতুন তাঁর মা। তাঁর মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্বটি কেটেছে বাগেরহাটে। সেখানেই তিনি ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। একই বছর ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সংবাদ ও কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক সত্যযুগ পত্রিকায় বাগেরহাট থেকে ডাকযোগে সংবাদ পাঠাতে শুরু করেন। নিছক কৌতুহল বশত: খবর লিখে পাঠানো, পরবর্তীতে তা ছাপার অক্ষরে দেখা এবং তাই সারাজীবন নেশার মতোই তাঁকে তাড়িয়ে নিয়ে বেরিয়েছে।
শুরুর পর্বে স্বাভাবিকভাবে তিনি ছিলেন খন্ডকালীন সংবাদদাতা। পেশাজীবী নন। তবে ওটাই তাঁর সাংবাদিকতার শুরু। পাশাপাশি ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি ১৯৫৩ সালে তার সম্পাদনায় বাগেরহাট থেকে মাসিক বিদ্যুৎ নামে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এখানে বলে রাখা ভালো, ১৯৫৩ সালে কবি হাসান হাফিজুর রহমানের সম্পাদনায় ঢাকা হতে একুশে সংকলন প্রকাশিত হয়। আর সারা পূর্ব-পাকিস্তানের জেলা-মহকুমা পর্যায়ে অসংখ্য সংকলন প্রকাশিত হতে শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পরেও অনেকদিন একুশে ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে এরকম অগণিত পত্রিকা, স্মরণিকা প্রকাশিত হতো। মনিরুল হুদা সম্পাদিত বিদ্যুৎ নামের পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশিত হতো। পর পর আট সংখ্যা প্রকাশিত হয়। তারপর মনিরুল হুদা উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে যান রাজশাহী কলেজে। ফলে বাগেরহাট হতে বিদ্যুত-এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়।
দৈনিক বাংলা থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি বেশ কিছুদিন সংবাদপত্র হতে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। আবারও ২০০৬ সালের ১০ জানুয়ারীতে তিনি দৈনিক জন্মভূমি’র প্রধান সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেন। আমৃত্যু তিনি সেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।
আগরতলা মামলা প্রত্যাহার, বাগেরহাটে ছাত্রদের মিছিলে হামলা ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে খুলনা ছিল উত্তাল। ওইদিন বিকেলে খালিশপুরে শ্রমিক-জনসভা ছিল। সকালে শিপইয়ার্ড এলাকা থেকে একটি জঙ্গি মিছিল হাজি মহসিন রোডের দিয়ে মিউনিসপ্যিাল পার্কে (শহীদ হাদিস পার্ক) আসছিল। এ রোডের মাঝামাঝি স্থানে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) ও খুলনা পৌরসভার প্রশাসক সৈয়দ আফজাল কাহুতের সরকারি বাসভবনের সামনে পুলিশের গুলিতে লন্ড্রী শ্রমিক হাদিসুর রহমানসহ তিন জন শহীদ হন। এই খবর শুনে বিকেলে খালিশপুর এলাকা হতে শ্রমিকরা মিছিল করে খুলনায় আসেন এবং সার্কিট হাউস ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় সন্ধ্যা নাগাদ জনসভায় অংশ নেওয়া বিক্ষুব্ধরা আইয়ুব খান সরকারের যোগাযোগ মন্ত্রী খান-এ সবুরের বাসভবনে হামলা করে। তখন ইপিআর-এর গুলিতে কটন মিলের শ্রমিক আলতাফ হোসেন ও রূপসা স্কুলের শিক্ষার্থী প্রদীপ মিস্ত্রীসহ সাত থেকে আট জন নিহত হয়। সহকর্মী আশরাফ উদ্দিন মকবুল ও আবু সাদেকের সাথে তিনি এ ঘটনাগুলো প্রত্যক্ষ করেন। প্রেস টেলিগ্রাম করে সংবাদটি দৈনিক পাকিস্তান কার্যালয়ে পাঠান। যেটি পরের দিন বিস্তারিত প্রতিবেদন ছাপা হয়।
সাংবাদিকতার কারণেই তিনি বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ন্যাপ প্রধান মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল মো. আইয়ুব খান, পাকিস্তানের বিরোধী দলীয় নেত্রী মিস ফাতেমা জিন্নাহ, মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী, মাদার তেরেসা, সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান, সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল এইচ এম এরশাদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া, ভারতের সাবেক সেনা প্রধান জেঃ মানেক শ’ ও এভারেস্ট বিজয়ী নেপালী তেনজিং নোরগে-এর সংস্পর্শে এসেছেন; তাঁদের অনেকের সাক্ষাৎ পেয়েছেন। রাষ্ট্রনায়কদের খুলনা সফরের উপর ভিত্তি করে দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক বাংলায় একাধিক প্রতিবেদনও ছাপা হয়েছে।
১৯৯১ সাল পরবর্তী বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সমন্বয় সংগ্রাম কমিটি ১৮ দফা দাবি নিয়ে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এ কমিটির ২৯ সদস্য প্রতিনিধি দলের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। প্রধানমন্ত্রীর কাছে তিনি খুলনাবাসীর পক্ষ থেকে রূপসা নদীর উপর সেতু, বিমান-বন্দর, ওয়াসা, মোংলা বন্দরের ড্রেজিং, শহর রক্ষা প্রকল্প ও খুলনা-মাওয়াসড়ক প্রশস্তকরণের দাবি উত্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী রূপসা নদীর ওপর সেতু, খুলনা-মাওয়া সড়ক প্রশস্তকরণ ও মোংলা বন্দর ড্রেজিং-এর বিষয়টি প্রাধান্য দেন।
তিনি তিন কন্যা ও এক পুত্রের জনক। তার চিরবিদায়ের এ সময়ে এ কিংবদন্তীর বর্ণাঢ্য কর্মজীবনের প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা।
খুলনা গেজেট/এএজে