হালকা শীতের অলস দুপুর। খুলনার চালনা পৌরসভার বৌমার গাছতলা বাজারের একটি চায়ের দোকানে ছোট্ট জটলা। পরিচয় দিয়ে আলাপ শুরু হলো পৌরসভা ও নির্বাচন নিয়ে। নকুল চন্দ্র বিশ্বাস নামের একজন বলে উঠলেন, ‘নামে পৌর শহর, কাজে কিছু না।’ বাকিরাও তাঁর বক্তব্য সমর্থন করলেন।
খুলনা জেলায় যে দুইটি পৌরসভা রয়েছে, তারমধ্যে চালনা পৌরসভা অন্যতম। নয়টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত ‘খ’ শ্রেণির এ পৌরসভার আয়তন ৯ দশমিক ৪৯ বর্গকিলোমিটার। পৌরসভা গঠনের ১৬ বছরেও এখানে শহুরে আবহ পুরোপুরি তৈরি হয়নি। পৌরসভার সদরের সড়কটি ধরে এর আশপাশে দোকানপাট, সরকারি অফিস-আদালত ঘিরে শহরতলি ভাব আছে। কিন্তু আঁছাভূয়া বাজার হয়ে সামনে এগোলে শহরের কোনো চিহ্ন চোখে পড়ে না। বেশির ভাগ বাড়িতেই গ্রামীণগৃহস্থ পরিবেশ। ধান কাটা, ধানমাড়াই নিয়ে ব্যস্ত অধিকাংশ বাড়ির মানুষ। পৌরসভা কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এখানে ৪টি গণশৌচাগার রয়েছে, তবে তা অস্বাস্থ্যকর।
পৌরসভার বাসিন্দা হিসেবে কেমন সেবা পান? এমন প্রশ্নের জবাবে চালনা বাজারের স্থানীয় বাসিন্দা মো. মজিদ গাজী (৫৪) বললেন, এলাকার রাস্তাঘাট মোটামুটি ভালো। কিন্তু পর্যাপ্ত ড্রেন নেই, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। বর্ষায় অনেক জায়গায় পানি জমে। বেশির ভাগ এলাকায় কোনো সড়কবাতি নেই।
একই ধরনের প্রশ্নের জবাবে আবদুর রহমান জানান, সেবা কী পান তিনি ঠিক জানেন না। তবে গ্রামের বাড়িতে যে লাউ ১৫ টাকা, এখানে সেটি তাঁকে কিনতে হয় ৩৫ থেকে ৪০ টাকায়।
স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, শহর এলাকা নিয়মিত পরিষ্কার করা হয় না। আছে মশার উপদ্রব। পৌরসভায় চিত্তবিনোদনের তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। ভালো খেলার মাঠ বা পার্ক নেই। প্রধান সড়কের আশপাশের সড়কের বেশ কটি এখনো কাঁচা। সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা নেই। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে শেয়ালের উপদ্রব। এছাড়া বাড়ছে মাদকসেবন, বিশেষ করে চালনা বাজারজুড়ে।
এত কিছু না থাকার পরও বাসিন্দারা অনেকে খুশি তাঁদের পৌরসভা নিয়ে। কেউ কেউ আশাবাদী, যেহেতু উপকূলী অঞ্চলে পৌরসভা ঘোষণা করা হয়েছে, তাই তাঁদের জীবনমানও দ্রুত আরও উন্নত হবে। তেমনই একজন বৌমার গাছতলা এলাকার তুলসী দাশ সেন। দোকানে বসে তিনি চা তৈরির কাজ করছিলেন। পৌরসভার বাসিন্দা হিসেবে বর্তমান সেবায় খুশি কি না-এমন প্রশ্নে হেসে উত্তর দিলেন, ভালোই তো। তবে সুপেয় পানি ও গ্যাস দরকার। ২০০৪ সালের নভেম্বর মাসে ‘গ’ শ্রেণির পৌরসভা হিসেবে যাত্রা শুরু করে চালনা পৌরসভা। ১০ বছরের মাথায় গিয়ে তা ‘খ’ শ্রেণিতে উন্নীত হয়। এখানকার জনসংখ্যা প্রায় ৩৩ হাজার। যদিও পৌরসভা আইন, ২০০৯-এ বলা আছে, পৌরসভা ঘোষণা করতে হলে জনসংখ্যা ৫০ হাজারের কম হবে না।
পৌরসভার সহকারি প্রকৌশলী প্রণব মল্লিকের দেওয়া তথ্যমতে, পৌরসভার মোট রাস্তার দৈর্ঘ্য প্রায় ৫০ কিলোমিটার। এরমধ্যে ৩ কিলোমিটারই কাঁচা। আড়াই কিলোমিটারের মতো জায়গায় এখনো বিদ্যুৎ পৌছায়নি। ড্রেন আছে সব মিলিয়ে ৪ কিলোমিটারের মতো। এরমধ্যে দেড় কিলোমিটারের মতো অকেজো অবস্থায় রয়েছে। সড়কবাতি আছে ১০টি, যা পৌর এলাকার মাত্র দুই শতাংশের মতো এলাকা কাভার করে।
বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পৌর এলাকার বাসিন্দাদের একটি বড় অংশ কৃষিনির্ভর। এখানে তেমন কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা কলকারখানা নেই। এ কারণে কাজের সুযোগও সীমিত। পৌরসভা কার্যালয়ের হিসাব অনুযায়ী, এখানে ক্ষুদ্রশিল্পের মধ্যে আছে তিনটি বয়লার রাইস মিল, ১২টি পোলট্রি ফার্ম এবং একটি এলপিজি গ্যাস কোম্পানি।
পৌরসভার অন্তত ২০ জন বাসিন্দা জানান, ‘এই পৌরসভার মধ্যে মোট জমির ৬০ শতাংশই ধানি জমি’। এটা কীভাবে পৌরসভা হলো তা মাথায় আসে না। মানুষের আয় রোজগারের সুবিধা নেই। পৌরকর বেড়েছে, কিন্তু পৌর-সুবিধা বলতে এখানে কিছু নেই। তারা আরও বলেন, জলাবদ্ধতা নিরসন না হওয়ায় ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। তাছাড়া পৌরসভার অধিকাংশ রাস্তা খানাখন্দে ভরা।
এই পৌরসভার বর্তমান মেয়র আওয়ামী লীগের সনত কুমার বিশ্বাস। তিনি আবারও দলের মনোনয়ন পেয়েছেন। বিএনপি থেকে মো. আবুল খয়ের খাঁন। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন অচিন্ত্য কুমার মণ্ডল ও গৌতম কুমার রায়।
খুলনা গেজেট / এআর