এম নূরুল ইসলাম। আপামর জনসাধারণের কাছে দাদু ভাই নামে পরিচিত। খুলনার সবচেয়ে জেষ্ঠ্য রাজনীতিক, সর্বজন শ্রদ্ধেয়। ছাত্রজীবন থেকেই প্রতিবাদী নূরুল ইসলাম ছিলেন স্বোচ্চার বজ্রকণ্ঠ। আজ খুলনাবাসী হারালেন দাদুভাইকে। বুধবার সকাল ৮টার দিকে খুলনা সিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ধক্যজনিত কারণে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেছেন তিনি।
ছাত্রজীবন থেকেই প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেন। জীবনের অন্তত ৭০ বছর রাজনীতির মাঠে-ময়দানে ছিলেন সরব। ছাত্রজীবন শেষে গণতন্ত্রপার্টির ব্যানারে মার্কবাদী দর্শণে বিশ্বাসী হয়ে সমাজ পরিবর্তনের লড়াই অংশ নেন। দুই যুগ ছিলেন বাম শিবিরে। ৭৮ সালে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী হয়ে ক্ষমতাসীন রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হন। এই রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হবার পর চারটি জাতীয় নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে লড়েছেন। জিতেছেন একবার। সবচেয়ে বড় অধ্যায় রাজনৈতিক গুরুর বিরুদ্ধেও গড়েছেন, শিষ্যের বিরুদ্ধে লড়েছেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি’র মনোনয়ন নিয়ে খুলনা-২ আসনে মুসলিম লীগের সভাপতি এক সময়কার গুরু খানএ সবুরের বিরুদ্ধে, ২০০১ সালে খুলনা-৪ আসনে তার রাজনৈতিক স্নেহভাজন আওয়ামী লীগের প্রার্থী এসএম মোস্তফা রাশিদী সুজার বিরুদ্ধে ছিল তার সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বিতা। আরও একটি উল্লেখ্যযোগ্য ঘটনা, দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সরকারি দলের প্রার্থী হয়েও জিলা স্কুল কেন্দ্রে ভোটের দিন কয়েক ঘন্টা পুলিশ হেফাজতে ছিলেন। রাজনীতিতে তার বড় স্বীকৃতি পাকিস্তান শাসনামলে খুলনা পৌরসভার কমিশনার, ভাষা সৈনিক, সংসদ সদস্য ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা।
আরও পড়ুন- ভাষা সৈনিক এম নূরুল ইসলামের ইন্তেকাল
জন্মপরিচয় ও ব্যক্তিগত জীবন : ১৯৩৪ সালের ২ মে খুলনা মহানগরীর ২০, বাবুখান রোডস্থ সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের জন্মগ্রহন করেন তিনি। মরহুম পিতা ডাঃ খাদেম আহমেদ (পেশায় চিকিৎসক) ও মাতা মরহুমা আছিয়া খাতুনের (গৃহিনী) ৬ ছেলে ও এক মেয়ের মধ্যে জেষ্ঠ্য সন্তান-ই খুলনার এই গর্বিত রাজনীতিক। দাম্পত্য জীবনে তিনি তিন ছেলে ও তিন কণ্যা সন্তানের জনক।
শিক্ষা ও রাজনৈতিক জীবন : প্রাথমিক শিক্ষা টুটপাড়া মডেল প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং মডেল স্কুলে সম্পন্ন করেন এম নূরুল ইসলাম। পিতার ডাঃ খাদেম আহমেদ এলএমএফ ডিগ্রীধারী তার নিজ এলাকার প্রথম মুসলিম চিকিৎসক ছিলেন। থাকতেন কলকাতায়। পিতার তত্ত্বাবধানে কলকাতা মেট্রোপলিটন হাই ইংলিশ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক (১৯৪৭) পাশ করেন তিনি। দেশ বিভক্তির পর খুলনায় চলে আসেন। সে সময় থেকে এ পর্যন্ত খুলনায় জীবনের সর্বস্তর কেটেছে। ১৯৪৭ সালে বিএল কলেজে ভর্তি এবং ১৯৪৯ সালে আইএ পাশ করেন তিনি।
ছাত্রাবস্থা থেকেই সমাজ সচেতন ব্যক্তিত্ব এবং নেতৃত্বের গুণাবলী অর্জন তার। ১৯৪৬ সালে নিখিল বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের খুলনা জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন এম নুরুল ইসলাম। নেতৃত্বদানের বলিষ্ঠতা, শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় সিক্ত হয়ে ‘দাদু ভাই’ নামে খ্যাত হয়ে উঠেন তিনি। খান এ সবুরের ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে রাজনীতি ও আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন দাদু ভাই। বিএল কলেজের ছাত্র হিসেবে নেতৃত্ব দিতেন খুলনা অঞ্চলে। ১৯৫২ সালে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সেই থেকে খান এ সবুরের রাজনীতির সাথে মত অনৈক্য হয় তার। ১৯৫৪ সালে হক ভাসানী-সৌহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের খুলনা জেলার অন্যতম তরুণ নেতা এবং খুলনার গণতান্ত্রিক আন্দোলনে পুরোধা এ্যাড. আব্দুল জব্বারের সংগ্রামী সহকর্মী হিসেবে অগ্রনী ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৭ সালে ন্যাপ প্রতিষ্ঠার সময় তিনি খুলনা শহর কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সালে খুলনা পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। ১৯৬৪ সালে খুলনার জাহানাবাদ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত এবং তৎকালীন ফাতেমা জিন্নাহর প্রেসিডেনসিয়াল নির্বাচনে সম্মিলিত বিরোধী দলের খুলনা জেলা স্টেয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৮-৬৯ সালে গণ-অভ্যূত্থানে নেতৃত্ব দানও কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেছিলেন এম নুরুল ইসলাম দাদু ভাই। ১৯৭২ সালে তিনি ন্যাপের খুলনা শহর শাখার সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ফ্রন্টে যোগদান ও প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৯ সালে বিএনপি’র খুলনা মহানগর শাখার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। একই সাথে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করেছিলেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে খুলনা-৪ (রূপসা-তেরখাদা-দিঘলিয়া) আসন থেকে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে শেষ জীবনেও এম নুরুল ইসলাম দাদুভাই রাজনৈতিক অঙ্গনে সরব ছিলেন।
খুলনা গেজেট/এআইএন