চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যদিয়ে চলছে সাতক্ষীরা পৌরসভা। প্রায় গত ২২দিন ধরে প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবা থেকে বঞ্চিত রয়েছেন পৌরবাসী। অতিপ্রয়োজনীয় নাগরিক সনদ না পেয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন পৌর সভার বাসিন্দারা। মুখ থুবড়ে পড়েছে পৌরসভার সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ। টাকা রিচার্জ করতে না পারায় বন্ধ হয়ে গেছে শহরের অধিকাংশ সড়কের বৈদ্যুতিক বাতি। পৌরসভার মেয়র ও প্যানেল মেয়রের দায়িত্ব পালন নিয়ে রশি টানাটানির কারণে এই বিশৃঙ্খল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যার ফল ভোগ করছেন পৌরবাসী।
এদিকে দুই মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বুধবার (২৩ আগষ্ট) সকাল থেকে পৌরসভার মূল ভবনের সামনে ময়লার গাড়ি ঢুকিয়ে অবরোধ করে সুইপাররা। এসময় তারা পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে বকেয়া দুই মাসের বেতনের দাবি জানায়। পৌর ভবনের সামনে ময়লার গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়ায় ভিতরে লোক প্রবেশ একরকম বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ঘন্টা দুইয়েক পরে পুলিশ এসে ময়লার গাড়ি সরিয়ে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনে।
পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা জানান, ভোর বলো থেকে কঠোর পরিশ্রম করে তারা পৌরসভার বর্জ্য অপসারণ করে থাকে। বিনিময় বেতনভাতা যা পায় তাই দিয়ে কোন রকমে তারা তাদের সংসার নির্বাহ করে থাকেন। কিন্তু গত দুইমাস ধরে তারা বেতন ভাতার টাকা পায়না। ফলে ছেলে মেয়েদের নিয়ে তাদের সংসার চালানো একরকম দায় হয়ে দাড়িয়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই উর্দ্ধগতির বাজারে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেকে আর্থিক দেনা হয়ে পড়েছেন। তারা বেতনভাতা পরিশোধে কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানান।
সাতক্ষীরা শহরের বাটকেখালী এলাকার সাইফুল ইসলাম ওরফে ছোট বাবু জানান, তার এক নিকট অত্মীয়ের ভারতে চিকিৎসা জন্য মেডিকেল ভিসা করতে একটা নাগরিক সনদ লাগবে। কিন্তু গত ১৫ দিন ধরে তিনি পৌরসভায় গিয়ে ফিরে আসছেন। মেয়রের স্বাক্ষর না হওয়ার কারণে তিনি নাগরিক সনদ পাচ্ছেন না। এভাবে আমার মত প্রতিদিন শত শত লোক পৌর সভায় গিয়ে তাদের কাঙ্খিত সেবা না পেয়ে ফিরে আসছেন। নাগরিক সনদ, ওয়ারেশকাম সনদসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাগজ পৌরসভা থেকে না পেয়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন পৌরবাসী।
শহরের কাটিয়া কলেজ রোড এলাকার বাসিন্দা আবু সাইদ জানান, বেশ কিছুদিন ধরে পৌরসভার অধিকাংশ সড়কে রাতের বলোয় সড়ক বাতি জ্বলছে না। ফলে অন্ধকারে লোকজনের চলাচল করতে বেশ সমস্যা হচ্ছে। এঅবস্থা আরো বেশ কিছুদিন অব্যহত থাকলে শহরে চুরি ও ছিনতাইসহ নানা ধরনের অপরাধমূলক কার্যক্রম বেড়ে যেতে পারে। তিনি রাতে পৌরসভার সড়ক বাতি চালু রাখতে কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন।
পৌরসভার ৯ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শেখ শফিক উদ দৌলা সাগর বলেন, টাকা রিচার্জ করতে না পারায় পৌর সভার অনেক সড়কের সড়ক বাতি বন্ধ হয়ে গেছে। মেয়র ও প্যানেল মেয়র কেউই দায়িত্ব পালন না করায় কোন টাকা ছাড় করানো যাচ্ছে না। যে কারনে বিদ্যুতের মিটার রিচার্জ করতে না পারায় রোড লাইট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে সড়কে এখনো লাইট চালু আছে আগামী কয়েক দিনের মধ্যে সেগুলোও বন্ধ হয়ে যাবে। বকেয়া বেতন ভাতা দিতে না পারায় সুইপাররা বুধবার সকালে ময়লার গাড়ি ঢুকিয়ে পৌর সভায় প্রবেশ পথ বন্ধ করে দেয়। এছাড়া কার্যাদেশ না পাওয়ায় পৌর সভার বেশ কয়েকটি সড়কের নির্মাণ কাজও বন্ধ হয়ে গেছে।
প্যানেল মেয়র-১ ও পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ ফিরোজ হাসান বলেন, গত ২ আগষ্ট থেকে মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি পৌরসভায় আসছেন না। মেয়র অফিসে না আসার কারণে কর্মচারীদের বেতনভাতা সহ কোন বিল ছাড় করানো যাচ্ছে না। তিনি কাউকে দায়িত্বও দিচ্ছেন না। এর ফলে টাকা রিচার্জ করতে না পারায় শহরের রোড লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। দুই একদিনের মধ্যে পৌরসভার পাইপ লাইনে পানি সরবরাহও বন্ধ হয়ে যাবে।
তিনি আরো বলেন, পৌরসভার সুইপাররা গত দুইমাস ধরে বেতন ভাতা পায়না। পানির কর্মচারীরাও তাদের বেতন পাচ্ছে না। কিন্তু আমরা ১২ জন কাউন্সিলর নিয়মিত অফিস করে নাগরিক সেবা দিয়ে যাচ্ছি। মেয়র তার দায়িত্ব পালন না করায় পৌরবাসী ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সাতক্ষীরা পৌরসভার সচিব মোঃ লিয়াকত হোসেন বলেন, মেয়র সাহেব বশে কিছুদিন ধরে অফিসে আসছেন না। কি কারণে তিনি আসছেন না, তা আমি বলতে পারবো না। তবে মন্ত্রণালয় থেকে আর্থিক দায়িত্ব না থাকায় প্যানেল মেয়রও কোন কাজ করতে পারছেন না। যে কারণে কর্মচারীদের বেতনভাতা প্রদানে সাময়িক সমস্যা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোঃ নাজিম উদ্দিন বলেন, গত ২২দিন ধরে মেয়র অফিসে আসেন না। আমাদের দুই জনের যৌথ স্বাক্ষরে সব ফাইলের কাজ করা হয়। কিন্তু তিনি অফিসে না আসার কারণে কোন ফাইলে কাজ করা যাচ্ছে না। উনি বাসয় ফাইল পাঠিয়ে দিতে বলেন। কিন্তু বাসায় গেলে উনাকে পাওয়া যায়না। যে কারনে প্রায় ৩৩ কোটি টাকার উন্নয়নমূলক কাজ আটকে গেছে। মিটারে রিচার্জ করতে না পারায় রোড লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। পানির মিটারও কয়েকদিনের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে। পৌর সভার কর্মচারীদেও বেতন দেয়া যাচ্ছে না। সাতক্ষীরা পৌরসভার সামগ্রিক বিষয় নিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে জানান তিনি।
এবিষয়ে জানার জন্য পৌর মেয়র তাজকিন আহমেত চিশতির ব্যক্তিগত মোবাইল নাম্বারে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি।
প্রসঙ্গত, গত ১৮ জুলাই ২০২৩ সাতক্ষীরা পৌরসভার মেয়র তাজকিন আহমেত চিশতিকে সাতক্ষীরা দায়রা জজ আদালত (সাতক্ষীরা থানার মামলা নং ৫, তারিখ ৩ এপ্রিল ২০২৩ এবং মামলা নং ৬৪, তারিখ ২৮ মে ২০২৩) ক্রিমিনাল মিস ১১০০/২৩ এবং ক্রিমিনাল মিস ১১০১/২৩ মামলায় জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করে জেল হাজতে প্রেরণ করেন। পরবর্তীতে গত ২ আগস্ট ২০২৩ স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফারজানা মান্নান স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে মেয়র তাজকিন আহমেদ চিশতি গ্রেপ্তার হওয়ায় দায়িত্ব পালনে অসমর্থ হওয়ায় তিনি স্বীয় দায়িত্বভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত কাজী ফিরোজ হাসানকে প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতাসহ মেয়রের দায়িত্ব অর্পণ করেন। উক্ত প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী কাজী ফিরোজ হাসান গত ৩ আগস্ট সাতক্ষীরা পৌরসভার সচিব লিয়াকাত হোসেনের নিকট থেকে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এদিকে গত ২৭ জুলাই কারাগার থেকে মুক্তি পান মেয়র তাজকিন আহমেত চিশতি। মুক্তি পাওয়ার পর তিনি বেশ কয়েকদিন অফিসও করেন। কিন্তু ২ আগষ্ট থেকে তিনি আর অফিসে যাচ্ছেন না। অপরদিকে প্যানেল মেয়র-১ কাজী ফিরোজ হাসানও দায়িত্ব পালন করছেন না। যে কারণে পৌরসভায় এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
খুলনা গেজেট/ টিএ